লিখেছেন – নিঝুম মজুমদারঃ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার নথি-পত্র, জেরা-জবানবন্দী, মামলার কার্যক্রম এগুলো খুবই ঠান্ডা মাথায় মন দিয়ে পড়বার পর একজন সুস্থ মানুষ অল্প কিছুক্ষণের জন্য হলেও মুষড়ে পড়বে এই কথাটা আমি খুব নিশ্চিত করে বলতে পারি।
আপনি এই মামলার জেরা ও জবানবন্দী জানবার পরে যে ক্রোধে আচ্ছাদিত হবেন এবং যে ব্যাথায় আপনি নিমজ্জিত হবেন সেটি কোনো ভাষা দিয়ে বর্ণনা করা অসম্ভব। কতটা নিষ্ঠুর ও নৃশংস উপায়ে তাঁরা জাতির জনক সহ তাঁর পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যা করেছে, সেটি আমি কোনোদিন লিখে প্রকাশ করতে পারব কিনা, আমি জানিনা। কিন্তু বাংলাদেশ একটা সভ্য জাতির মত পরম ধৈর্য্য নিয়ে এই সুনির্দিষ্ট বিচারকাজ চালিয়ে গেছে।
আমার ইতিহাস পাঠ অভিজ্ঞতা জানায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্ন উঠেছিলো তখন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিল এইসব অপরাধীদের বিচারের পরিবর্তে গুলি করে মারার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু মিত্র বাহিনীর অন্যান্য দেশের বিরোধিতার সেটি আর সম্ভব হয়নি।
এই মামলা পরিচালনা করবার একবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কার্যক্রম গুলো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই ভয়ানক খুনীদের কি পরিমান সুযোগ ও সুবিধা দেয়া হয়েছিলো বিচারিক কার্যক্রমে। তাদেরকে ডিভিশন সুবিধা প্রদান থেকে শুরু করে কি সুবিধা ছিলোনা, যেটি দেয়া হয়নি?
আপনারা সকলেই জেনে থাকবেন যে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার যাতে না হতে পারে সে জন্য খুনী মোশতাক একটি অধ্যাদেশ জারি করে ১৯৭৫ সালের ২৬ শে সেপ্টেম্বর। এই অধ্যাদেশকেই কুখ্যাত “ইন্ডেমনিটি অধ্যাদেশ” বলে। যেই অধ্যাদেশের মাধ্যমে পরিষ্কার ভাবে বলে দেয়া হয় যে, খুনীদের বিরুদ্ধে কোন রকমের আইনী ব্যবস্থা গ্রহন করা যাবে না।
আসুন দেখে নেই কি লেখা ছিলো সেই অধ্যাদেশে-
Restrictions on the taking of any legal to other proceedings against persons in respect of certain acts and thing …(a) Notwithstanding anything contained in any law, including a law relating to any defence service, for the time being in force, no suit, prosecution or other proceedings, legal or disciplinary, shall lie, or be taken, in before or by any Court, including the Supreme Court and Court Martial, or other authority against any person including a person who is or has, at any time, been subject to any law relating to any defence service, for on account of or in respect of any act, matter or thing done or step taken by such person in connection with, or in preparation or execution or any plan for, or as necessary step towards, the change of Government of the People’s Republic of Bangladesh and the proclamation of Martial Law on the morning of the 15th August, 1975.(b) For the purposes, of this section, a certificate by the president, or a person authorised by him in this behalf that any act, matter or thing was done or step taken by any person mentioned in the certificate in connection. With, of in preparation or execution of any plan for, or necessary step towards, the change of Government of the People’s Republic of Bangladesh and the proclamation of Martial Law on morning of the 15th August, 1975, shall be sufficient evidence of such act, matter or thing having been done or step having been taken in connection with or in preparation or execution of any plan for, or as necessary step towards, the change of such Government and the proclamation of Martial Law on that morning.
একটি দেশে সংগঠিত হত্যাকান্ডের বিচার হতে পারবে না বা করা যাবেনা, এমনতর কথা বলে সরকারী পর্যায়ে অধ্যাদেশ জারি করাটা বিরল ঘটনা। এই ঘটনার পর পর আরো আশ্চর্য ঘটনা হচ্ছে ১৯৭৯ সালের ৬-ই এপ্রিল তৎকালীন অবৈধ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মোশতাকের রেখে যাওয়া সে অধ্যাদেশ সংবিধানের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। জিয়া বাংলাদেশের সংবিধানকে কতটা নিম্নস্তরে নামিয়ে এনেছিলো, এটি শুধু এই একটি ঘটনা থেকেই বুঝতে পারা যায়।
আপনারা এটি শুনলেও বিষ্মিত হতে পারেন যে, ১৯৯৬ সালের ১২-ই নভেম্বরে যখন জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে রাত ১০ টা ৭ মিনিটে এই কুখ্যাত ইন্ডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা হোলো তার বিরুদ্ধে রিট করেছিলো দু’জন ব্যাক্তি। একজন হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর খুনী কর্ণেল সৈয়দ ফারুক রহমানের মা মাহমুদা রহমান আর আরেকজন ছিলো খোদ খুনী কর্ণেল শাহরিয়ার রশীদ খান।
এর মধ্যে একটি তথ্য আপনাদের জানিয়ে রাখি যে, এই ইন্ডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের সময় বি এন পি ও জামাত সংসদ থেকে ওয়াকাউট করেছিলো এবং জাতীয় পার্টির এম পি এন কে আলম চৌধুরী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলো যে ইন্ডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের আগে যাতে জনমত যাচাই করে নেয়া হয়।
চিন্তা করা যায়? খুনের বিচার করতে পারবে না বলে আইন করা হয় এই বাংলাদেশে আবার সেটি বাতিল করতে গেলে জনমত যাচাইয়ের কথা তোলা হয়!! আমরা এমনই এক দেশের নাগরিক।
যা বলছিলাম,
উল্লেখিত রিটে খুনী ও খুনীদের স্বজনরা হেরে গেলে তারা এটি’র উপর আবার আপীল করে। বিচারপতি মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক ও বিচারপতি এম এ মতিনের সমন্বয়ে ডিভিশন বেঞ্চ উন্মুক্ত আদালতে প্রায় ২ ঘন্টা ধরে ৮৭ পৃষ্ঠার এই রায় পড়ে শোনান। এদিন ছিলো ২’শরা মার্চ ১৯৯৭।
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে অফিসিয়ালী দল ক্ষমতায় এসেছিলো ২৩-ই জুন ১৯৯৬ সাল। কিন্তু ইন্ডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল, বিচারের প্রস্তুতি, বিরুদ্ধ রিট, মামলার তদন্ত, চার্জশীট এগুলো সব কিছু পেরিয়ে এসে বিচার শুরু হতে লেগে যায় ১২-ই মার্চ ১৯৯৭ তারিখ পর্যন্ত। মানে দাঁড়ায় ক্ষমতায় আসবার পরে সকল আইনী বাঁধা-বিপত্তি সব কাটিয়ে বিচার শুরু করতে লেগে যায় প্রায় ৯ মাস। এক বছরের কাছাকাছি সময়।
বিচার যখন শুরু হয় তখন বিচারকের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনা হয়, এই অনাস্থা আবেদন যায় হাইকোর্টে, হাই কোর্ট আবার তা বাতিল করে, আবার ওই একই বছরের মে মাসের ৪ তারিখে এই মামলায় জোয়াবয়দা রশীদকে কেন আসামী করা হয়েছে এটি নিয়ে করা হয় পিটিশন। বিচার কাজ বন্ধ থাকে প্রায় এক মাস।তারপর আবার বিচার শুরু হয় ৬-ই জুলাই ১৯৯৭ তারিখে।
এরপর বিচার চলতে থাকে এবং ১৯৯৮ সালের ৮ ই নভেম্বর তারিখে জজ কাজী গোলাম রসুল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ১৫ জন আসামীকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করিয়ে গুলি করবার নির্দেশ দেন এবং একই সাথে এই মামলার বাকী ৪ অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস করবার রায় দেন।
এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীলে করে খুনীদের আইনজীবিরা।নিম্ন আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও মৃত্যুদন্ড নিশিচকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ বিভক্ত রায় দেন।
বিচারপতি এম রুহুল আমিন ১৫ আসামির ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। খালাস দেন পাঁচ আসামিকে। অপর বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ১৫ আসামির সবার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।
এরপর ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। খালাস দেন তিনজনকে।
বি এন পি’র ২০০১ থেকে ২০০৬ আমলে এই বিচার বলা চলে অনেকটা বন্ধ ছিলো। হাইকোর্টের আপীলেট ডিভিশানে বিচারপতি সংকটের কথা বলে বিএনপি এই বিচার আদতে বন্ধ করে রাখে। আমার মনে আছে ব্যারিস্টার মওদুদ প্রায়ই আইনী ঝামেলা গুলো দেখিয়ে পাবলিককে বোকা বানার চেষ্টা করত নানা কাহিনী বুঝিয়ে। কিন্তু সাধারন মানুষ জানতো, বি এন পি হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর রক্তের মাধ্যমে জন্ম নেয়া একটা দল। এইসব খুনীদের সবচাইতে বড় বেনিফিশিয়ারী কি কখনো খুনীদের বিচার করবে? উল্টো বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার রায়ের দিন বি এন পি হরতাল আহবান করেছিলো। সে কথাও আমরা ভুলে যাইনি।
দীর্ঘ ছয় বছর পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে আপিল বিভাগে একজন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার পর ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. তোফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন।
এর প্রায় দুই বছর পর ২০০৯ সালের ২৪ আগস্ট আপিল শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি ওই বছরের ৫ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করেন।
আপিল শুনানির জন্য তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিন ৪ অক্টোবর ২০০৯ তারিখে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. তোফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ গঠন করেন।আপীল বিভাগের এই বাকী চার বিচারপতি ছিলেন যথাক্রমে বিচারপতি জনাব সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বি কে দাশ, মোহাম্মদ আবদুল আজিজ ও বিচারপতি মোজাম্মেল হোসাইন।
আপিল বিভাগ ৫ অক্টোবর ২০০৯ থেকে টানা ২৯ কর্মদিবস শুনানি করার পর ১৯ নভেম্বর ঐতিহাসিক এক রায়ে সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দি পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। এরপর খুনীদের করা পুনর্বিবেচনার আবেদন-ও খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।
৩ জানুয়ারি ২০১০ তারিখে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আবদুল গফুর আসামিদের মৃত্যুপরোয়ানা জারি করেন। পরবর্তীতে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি কার্যকর হয়।
মানে দাঁড়াচ্ছে, ১৯৯৭ সালের ৬ ই জুলাই থেকে শুরু হয়ে তা কার্যকর করতে ২০১০ সালের ২৮ শে জানুয়ারী পর্যন্ত প্রায় ১২ বছর লেগে গেছে এইসব আত্নস্বীকৃত খুনীদের বিচার সম্পন্ন করতে। বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনকের এই হত্যাকান্ডের খুনীরা নিজেরা তাদের অপরাধ প্রকাশ্যে স্বীকার করবার পরেও যখন এই বিচার হতে গুনে গুনে বারোটি বছর চলে যায় তখন বিষ্মিত না হয়ে আসলে আর কোনো উপায় থাকেনা।
এই মামলার জেরা ও জবানবন্দী অনেক দীর্ঘ। ৬১ জন সাক্ষী, তাদের জবানবন্দী, অপরাধীদেরকে করা জেরা, তাদের জবানবন্দী এসব সব কিছু অত্যন্ত দীর্ঘ। পড়বার একটা পর্যায়ে আমার মনে হচ্ছিলো হেলুসিনেশনের মত হচ্ছে।আমার মনে হচ্ছিলো ১৫-ই অগাস্ট খুব ভোরে আমাকেও কালো পোষাকের সেই খুনীরা দাঁড় করিয়েছে মুহিতুল,রমা কিংবা ভালোবাসার শেখ রাসেলের পাশে।
(২)
জেরার একটা পর্যায়ে উইটনেস স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো সাক্ষী মহিতুল ইসলামকে আইনজীবি শরফুদ্দিন আহমেদ মুকুল বললেন, “আত্নঘাতি বোমায় বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে দোতলায় অবস্থানের শিশু শেখ রাসেলসহ সকল মহিলা মারা যায়?”
উত্তরে মহিতুল ইসলাম বলেন, “কথাটি সত্য নয়। হত্যাকারীদের গুলিতে সকলেই মারা যায়”
আমরা যদি এই জেরার দিন থেকে প্রায় ২২ বছর আগের ধানমন্ডির ৩২ নাম্বার বাড়ির ভেতর চলতে থাকা ঘটনার দিকে তাকাই, আমরা দেখতে পাই কালো ও খাকি পোষাক পরা সেনাবাহিনীর সৈন্যদের। পাকিস্তানি মিলিশিয়াদের মত কালো ঘুটঘুটে পোষাক পরে জমদূতের মত সেদিন তারা জাতির জনকের বাসায় এসেছিলো একটি পরিবারের সকলকে খুন করবার জন্য। [১৯৯৭ সালে জেরা হচ্ছিলো এটি ধরে]
এই যমদূতদের মধ্যে অন্যতম প্রধান বজলুল হুদার নেতৃত্বে জাতির জনকের বাসার সামনে ডি এস পি নুরুল ইসলামকে চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসা হোলো সারিবদ্ধ লাইনে। এখানে জানিয়ে রাখি, এই সারিবদ্ধ লাইন করবার আগে এরই মধ্যে খুনী বজলুল হুদা ব্রাশ ফায়ার করে খুন করেছে জাতির পিতার বড় পূত্র প্রিয় শেখ কামালকে।
আবার আমরা ফিরে আসি সারিবদ্ধ সেই লাইনে।
এখানে আগের থেকেই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কর্মরত এস বি’র (পুলিশের স্পেশাল ব্র্যাঞ্চ) কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান ও টেলিফোন মিস্ত্রী আব্দুল মতিন। একটা পর্যায়ে জাতির জনকের ছোট ভাই শেখ নাসেরকেও সেই লাইনে এনে দাঁড় করানো হয়। কিছু বুঝে উঠার আগেই আর্মির এক সেনা গুলি করে মেরে ফেলে এস বির সেই কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমানকে।
সারিতে দাঁড়ানো শেখ নাসের একটা পর্যায়ে আর্মির লোকদের দিকে তাকিয়ে বলেন, “স্যার, আমি তো রাজনীতি করিনা। ব্যবসা বাণিজ্য করে খাই”
পাশে দাঁড়ানো একজন আর্মি অফিসার তখন বলে, “শেখ মুজিব ইজ বেটার দ্যান শেখ নাসের”
আর্মির অন্য আরেকজন লোক তখন শেখ নাসেরের দিকে তাকিয়ে বলে, “ঠিক আছে আপনাকে কিছু বলব না। আপনি ঐ রুমে গিয়ে বসেন”
পাশের রুমে নেবার কথা বলে শেখ নাসেরকে বাথরুমে নিয়ে গুলি করে আর্মির একজন। শেখ নাসের “পানি পানি” বলে চিৎকার করতে থাকলে আর্মির আরেকজন বলে ওঠে, “যা পানি দিয়ে আয়”।
পানি দেবার কথা বলে আবার গুলি করা হয় শেখ নাসেরকে।
এই ঘটনা যখন চলছিলো সে সময়ের মধ্যে জাতির জনকের বাসার সাহায্যকারী রমা ও তাঁর কনিষ্ঠপূত্র ১০ বছরের শেখ রাসেলকে সেই সারিবদ্ধ লাইনে এনে দাঁড় করায় খুনী সৈন্যরা।
রাসেল প্রথমে রমাকে এবং তারপর মহিতুল ইসলামকে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেন। ছোট্ট শিশুটি মহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে্ন “ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?”
মহিতুল ইসলাম ভেবেছিলেন অন্তত এই শিশুকে খুনীরা মারবে না। সে আশাতেই তিনি শিশু রাসেলকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন “না ভাইয়া তোমাকে মারবে না”
ঠিক এই সময় খুনে আর্মিদের একজন শেখ রাসেলকে জোর করে টানতে থাকে। আলাদা করতে চায় মহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে রাখা প্রিয় শেখ রাসেলকে।
শেখ রাসেল সে সময় বলেন, “আমি আম্মুর কাছে যাব”। সেই সৈন্য শেখ রাসেলের দিকে তাকিয়ে বলে, “চলো, তোমাকে আম্মুর কাছে নিয়ে যাব”
ঠিক এই দৃশ্যটিতে এই মুহুর্তে আপনারা একটু থেমে যান। এই দৃশ্যের সামান্য সময় আগে আমরা চলুন ঘুরে আসি ৩২ নাম্বারের দোতলা থেকে।
মেজর মহিউদ্দিন তখন তার ফোর্স নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নীচে নামাচ্ছিলো। নীচতলা থেকে এরই মধ্যে দোতলার ওই সিঁড়ির নীচে এসে দাঁড়িয়েছে বঙ্গবন্ধুর দুই ঘাতক মেজর বজলুল হুদা ও লেঃ কর্ণেল নূর চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু জোরে হাঁক দিলেন দোতলার সিঁড়ির নীচে দাঁড়ানো বজলুল হুদা এবং মেজর নূরের দিকে তাকিয়ে বল্লেন, “তোরা কি চাশ? আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি”
নূর চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়ানো মহিউদ্দিনকে ও তার ফোর্সকে সরে যেতে বলল। তারপর মুহুর্তেই নূর চৌধুরী ও বজলুল হুদা, এই দুইজনই ব্রাশ ফায়ার করলো বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু লুটিয়ে পড়লেন সিঁড়ির উপর।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সংবাদ রমা, বেগম মুজিবকে এসে জানান। বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজী জামাল,শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ রাসেল, শেখ নাসের সবাই বেগম মুজিবের বেডরুমের সাথে লাগোয়া বাথরুমে আশ্রয় নেয়।
বঙ্গবন্ধুকে খুন করে চলে যাওয়া নূর, বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন ও তার ফোর্স হেঁটে এসে দাঁড়ায় ৩২ নম্বরের বাড়ীর বাইরের রাস্তায়। এই খুনীরা বঙ্গবন্ধুকে খুন করে বাইরে দাঁড়ালে দ্বিতীয় মিশনের জন্য এবার উপরে উঠে আসে মেজর আজিজ পাশা, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ও তাদের ফোর্স। এই সময়ে ড় সাথে ছিলো বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর নিরাপত্তার সার্বিক দায়িত্বে থাকা সাথে ছিলো সুবেদার মেজর আবদুল ওয়াহাব জোয়ারদার।
মেজর আজিজ পাশা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং বেগম মুজিবের বেডরুমের সামনে এসে দরজা খোলার জন্য চিৎকার করতে থাকে। দরজা না খোলায় আজিজ পাশা দরজা বরাবর গুলি করে। একটা পর্যায়ে বেগম মুজিব দরজা খোলেন। বেগম মুজিব খুনীদের প্রতি অনুরোধ করেন পরিবারের সদস্যদের খুন না করতে।
কয়েকজন ফোর্স দু দিক থেকে বেগম মুজিবের হাত ধরে তাঁকে নীচে নামিয়ে নিয়ে যেতে চায়। সিঁড়ির কাছে আসতেই বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখে আর্ত চিৎকার করে ওঠেন বেগম মুজিব। তীব্র কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। তিনি সৈন্যদের বলেন তাঁকে এখানেই মেরে ফেলতে।
এরই মধ্যে আজিজ পাশা ও রিসালদার মোস্লেমউদ্দিনের সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুর রূম থেকে তাঁর ভাই শেখ নাসের, রমা ও শেখ রাসেলকে নীচে নামিয়ে নিয়ে যায় আর বঙ্গবন্ধুর রুমে নিয়ে গিয়ে মেজর আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন গুলি করে খুন করে বেগম মুজিব, শেখ জামাল, রোজী জামাল ও সুলতানা কামালকে।
উপরে আমি যে দৃশ্য থেকে আপনাদের থেমে যেতে বলেছিলাম, এইবার সেই দৃশ্যে আবার ফিরে আসি।
ছোট্ট শিশু শেখ রাসেল বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন সৈন্যরা তাঁকে তাঁর মায়ের কাছে নিয়ে যাবেন। কিন্তু সেটি আসলে হয়নি। খুনীরা শেখ রাসেলকে নিয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর রুমে যেখানে এরই মধ্যে নিথর হয়ে পড়ে রয়েছেন শিশু রাসেলের মা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, ভাই শেখ জামাল, ভাবী রোজী জামাল ও সুলতানা কামাল।
রাসেল এই পর্যন্ত আসতে দোতলার সিঁড়িতে পেরিয়ে এসেছিলেন তাঁর পিতার রক্ত। পিতার রক্তের স্রোত দেখে ঠিক ওই সময় তিনি কি বলেছিলেন আমরা সেটি আর জানতে পারিনা। তিনি কি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিলেন? তিনি কি ভয়ে চিৎকার করেছিলেন? আমরা এও জানতে পারিনা যে মায়ের নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখে কি ভেবেছিলেন শিশু রাসেল। দুই ভাবীর মৃত দেহ, বড় ভাইয়ের মৃত দেহ, মায়ের মৃত দেহ সব কিছু হয়ত উলোট পালট করে দিয়েছিলো শিশু রাসেলের বুক। শেখ রাসেল কি ভেবেছিলেন সেটি আমরা যখনই ভাবতে যাব ঠিক তখনই আমরা আরো ঘনীভূত হই আরো একটি মর্মান্তিক দৃশ্যের দিকে। শিশু রাসেলকে গুলির পর গুলি করে খুন করা হয় বাবা-মায়ের এই বেডরূমেই।
হয়ত এই শিশুটি খুনীদের হাত ধরে বাঁচার জন্য কাকুতি-মিনতি করেছি্লেন। হয়ত তার দুইটি অবুঝ হাত দিয়ে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত ঠেকাতে চেয়েছিলো গুলি গুলোকে। কি জানি…আমাদের চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, আমাদের বুক বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে বলে, এই সময় আমরা আর কিছুই ভাবতে পারিনা।
আমরা এই রক্তাক্ত ইতিহাসের এই সময়ের কিছুই আর জানতে পারিনা। আমরা শুধু জানতে পেরেছিলাম শিশু রাসেল চারিদিকে রক্তাক্ত এক সমুদ্রে নিথর হয়ে পড়েছিলো ভাবী সুলতানা কামালের পাশে। তাঁর মাথার মগজ বের হওয়া ছিলো, তাঁর দুইটি চোখ ছিলো বের হওয়া। মানে দাঁড়ায় খুনীরা শেখ রাসেলের দুইটি চোখ বরাবর গুলি করেছিলো। অথচ খুনীরা নীচ তলা থেকে শিশুটিকে নিয়ে এসেছিলো মায়ের কাছে নিয়ে যাবে, এই কথা বলে। তাঁকে খুন করবে না, এই কথা বলে।
ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, শিশু রাসেলের হত্যার পর পরই ৩২ নম্বর বাসার নীচে দাঁড়িয়ে থাকা বজলুল হুদা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক খুনী, মূল পরিকল্পনাকারী মেজর ফারুক কে বলছে “অল আর ফিনিশড”
এই লেখাটির একেবারে শুরুতে আমি একটি জেরার বর্ণনা দিয়ে শুরু করেছিলাম। এই পর্যায়ে চলুন আমরা বরং সেই অংশটিতে আবার ফেরত চলে যাই।
উপরে উল্লেখিত জেরাটি করা হচ্ছিলো এই মামলার অন্যতম প্রধান সাক্ষী মহিতুল ইসলামকে যিনি ১৫-ই অগাস্টের সেদিনের ঘটনার একজন বড় প্রত্যক্ষ্যদর্শী, সাক্ষী ও মামলার এজাহারকারী।
এই মামলাতে তাহের উদ্দিন ঠাকুরের আইনজীবি শরফুদ্দিন আহমেদ মুকুল সাক্ষীকে জেরা করে এটি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে মহিতুল ইসলাম যা বলছেন সব মিথ্যে ও বানোয়াট এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সবাই আত্নঘাতি বোমা হামলা করে মরে গেছেন। কেউ তাঁদের খুন করেনি। কেউ সেদিন এই বাসাতে খুন করতে আসেনি।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের নিম্ন আদালতের রায়, হাইকোর্টের রায়, আপীলেট ডিভিশানের রায়, জেরা, জবানবন্দী, যুক্তি-তর্ক, এসব পড়তে পড়তে কেমন যেন ক্লান্ত লাগে। একজন বাংলাদেশী হিসেবে নিজেকে খুব বড় বেশী গ্লানিময় আর অপবিত্র মনে হয়। যখনই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড নিয়ে পড়ি আর লিখতে বসি তখনই নিজের ভেতরে এক ধরনের সুতীব্র বেদনা ও গ্লানির মিশেল আমাকে একাকার করে দেয়। এই অনুভূতিকে ঠিক কিভাবে লিখলে সেটিকে সঠিক অনুভূতির প্রকাশ বলে অভিহিত করা হবে, আমার সেটি জানা নেই।
এই দেশের জল আর বায়ুতে বড় হওয়া একজন আইনজীবি প্রমাণ করতে চেয়েছিলো বঙ্গবন্ধু খুন হন নি, তিনি নিজে নিজেই গায়ে বোমা বেঁধে মরে গেছেন, তারা প্রমান করতে চেয়েছিলো এই খুন সেদিনের খুনীরা করেনি করেছে অন্য কোনো “তৃতীয় শক্তি”।
তারা বলতে চেয়েছিলো খুনী ফারুক, রশীদ, সুলতান শাহরিয়ার, নাজমুল,আজিজ পাশা, ডালিম, বজলুল, নুর সহ সকলেই নিষ্পাপ।
এই দেশের আমলারা, রাজনীতিবিদেরা, আর্মির অফিসাররা বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার আটাকাবার জন্য অধ্যাদেশ করেছে, সংবিধানে নিজেদের ইচ্ছেমত অনুচ্ছেদ বানিয়েছে, এই খুনীদের সংসদ সদস্য বানিয়েছে, তাদেরকে রাজনৈতিক দল করবার অনুমতি দিয়েছে, রাষ্ট্রদূত বানিয়েছে। ইনফ্যাক্ট এই দেশের মানুষ এদেরকে ভোট দিয়েছে একটা সময়। এই দেশের মানুষ গুজব ছড়িয়েছে বছরের পর বছর এই বলে যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মানুষ নাকি মিষ্টি বিতরন করেছে।
কি বলব এইসব কষ্টের কথা…
আমরা অনেক সময় খুব গর্ব করি এই দেশ নিয়ে, দেশ ক্রিকেটে জিতে গেলে গর্ব করি, কেউ ভালো কাজ করলে গর্ব করি, কেউ অনেক উপরে উঠে বিশ্ব সীমানায় পৌঁছে গেলে সেটি নিয়ে গর্ব করি, আমরা নানা রকমের সুযোগের অপেক্ষায় থাকি এই দেশ নিয়ে গর্ব করবার জন্য।
কিন্তু, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবার, তাঁর আত্নীয় স্বজনকে হত্যা করবার পুরো অধ্যায়টি পড়বার পর এই দেশের প্রতি আমার এক ধরনের প্রবল ঘৃণাবোধ হয়। আমার ভয়ংকর এক ধরনের বেদনা হয়। মনে হয় লজ্জায় আর অপমানে মিশে যাচ্ছি একাকার হয়ে।
আমি জানি, কিছু মানুষের নৃশংসতা’র কারনে পুরো দেশকে ঘৃণা করাটা হয়ত যৌক্তিকভাবে ঠিক নয়। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন সময় আসে, যেখানে আপনার আবেগ, আপনার যুক্তি এগুলো সব কিছুই আপনাকে মুহূর্তে তুচ্ছ করে দেবে।
আপনাকে অর্থহীন করে দেবে। আপনাকে শেষ করে দেবে।