সারা দিনের দুটো ঘটনা ভয়ানক ভাবে প্রভাবিত করে রেখেছে। দুটোই ফেসবুকের কল্যানে। এক হচ্ছে প্রভাষ আমিন নামের এক ভদ্রলোকের একটি লেখা টাইমলাইনে পড়ে আর দ্বিতীয়ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সংলাপের সময় ভেতরের কথা বার্তা নিয়ে আমার ফেসবুক পোস্টে বিভিন্ন পাঠকের মন্তব্য।
আমার ঠোঁট কিছুটা যেহেতু কাটা সে কারণেই খুব সম্ভবত, হাত টা নিশ-পিশ করছিলো কিছু লিখি। ফলে লিখতে বসে গেলাম।
প্রভাষ আমিন নামের এক ভদ্রলোক, ব্যাক্তিগত ভাবে পরিচয় নেই। তিনি ঢাকা টাইমস নামের একটি পত্রিকায় “পঁচাত্তরের কুশীলবরাও মাঠে?” এই শিরোনামে একটি লেখা লিখেছেন। লেখাটা পড়লাম।
বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সহযোগী জনৈক মেজর খায়রুজ্জামানের প্রসঙ্গ এসেছে তাঁর লেখায়। আরো এসেছে খায়রুজ্জামানের স্ত্রী রিটা রহমানের কথা যিনি বর্তমানে পিপলস পার্টি অফ বাংলাদেশ নামে একটি দলের আহবায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
জনাব আমিন অত্যন্ত শংকিত বোধ করছেন রিটা রহমান রাজনৈতিক দল গঠন করে ঠিক ইলেকশনের আগে আগেই আবির্ভূত হয়েছেন বলে। তাও আবার রিটা রহমানের বাবা বিখ্যাত রাজাকার মশিউর রহমান যাদু মিয়া। এক সময় ভাসানীর ন্যাপ করত। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যাদু মিয়াকে বিশেষ আইনে গ্রেফতার করে তাকে রাজাকারীর/দালালীর দায়ে বিচারের তোড়জোড় শুরু করা হয়।
কিন্তু আফসোস সে সময় মাওলানা ভাসানী এই যাদু মিয়ার পক্ষে দেশে এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরী করেন। তিনি তার দলবল সহ যাদু মিয়ার মুক্তির জন্য এমন কোনো কাজ নেই যেটা করেন নি। পরে অবশ্য তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার যাদুকে ছেড়ে দেয়।
জানিয়ে রাখা ভালো যে উপরের এসব সব তথ্য আমি জেনেছি তৎকালীন সময়ের পত্রিকা পড়ে, সে সময়ভিত্তিক বিভিন্ন পুস্তক, কলাম ইত্যাদি পাঠ করে।
জনাব আমিনের এইসব পার্টিকুলার শংকার বা উদ্বিগ্নতা নিয়ে আমার প্রশ্ন নেই। আমার শ্বশুর সাংবাদিক (দৈনিক মিল্লাতের এডিটর ছিলেন) চৌধুরী মোহাম্মদ ফারুক নিজেই ছিলেন একজন বঙ্গবন্ধু বিরোধী লোক। ভয়াবহ এন্টি আওয়ামীলীগার। বঙ্গবন্ধুর খুনীর দল ফ্রিডম পার্টির উঁচু পদে উনার অবস্থান ছিলো মৃত্যুর আগদিন পর্যন্ত। ফলে, উনি যখনই রাজনৈতিক কোনো মুভমেন্টে যেতেন বা মিডিয়ার মাধ্যমে আমি দেখতে পেতাম, আমি নিশ্চিত থাকতাম যে এটি কোনোভাবেই আওয়ামীলীগের পক্ষের কিছু নয়।
কিন্তু আমার প্রশ্ন এখানে নয়। প্রশ্ন হচ্ছে প্রভাষ আমিন কেন আওয়ামীলীগের ভেতরে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বেনিফিশিয়ারী, সহযোগীদের কথা বলেন না? কেন প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে থাকা ষড়যন্ত্রকারী কিংবা বঙ্গবন্ধুর খুনীদের তৈরী রাজনৈতিক দল ফ্রিডম পার্টির মূল কারিগর লে জে হো মু এরশাদের কথা বলেন না?
খুনী মোশতাকের মন্ত্রীসভার শপথ পাঠ করানো এইচ টি ইমাম, যিনি আজকে আওয়ামীলীগের অনেক বড় একজন র্যাম্বো, বড় একজন হনু, বড় একজন উপদেষ্টা, সেই ইমাম সাহেবের কথা আমিন সাহেবরা কেন বলেন না? তারা কি ইমাম সাহেবের ভয়ে বলেন না? এর ব্যখ্যাটা কি?
মুসা সাদিকের গ্রন্থ “১৫ ই আগস্ট ট্রাজেডি ও বঙ্গভবনের অজানা অধ্যায়” থেকে জানা যায় যে-
“১৫ ই আগস্ট বিকেলে বঙ্গভবনে খুনি খন্দকার মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানের তোড়জোড় শুরু করেন তিনজন মন্ত্রীপরিষদ সচিব এইচ টি ইমাম, রাষ্ট্রপতির সচিব আব্দুর রহিম, এবং স্বঘোষিত মুখ্য সচিব মাহবুব উল আলম চাষী। খুনি মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানের ভাব গাম্ভীর্য বৃদ্ধির জন্য মন্ত্রীপরিষদ সচিব এইচ টি ইমাম এবং রাষ্ট্রপতির সচিব আব্দুর রহিম খুনি মোশতাক – ডালিম – ফারুকদের সাথে ঘনঘন বৈঠকে বসেন। মন্ত্রীপরিষদ সচিব এইচ টি ইমাম বঙ্গভবনে বসে সকল মন্ত্রীদের ও সচিবদের ফোন করে খুনি রশিদ – ডালিম – ফারুকদের নাম করে ধমকাতে লাগলেন। যাতে তারা সবাই খুনি মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে শপথ নেন এবং সচিবরা উপস্থিত হয়ে অনুষ্ঠানের মান মর্যাদা শ্রীবৃদ্ধি করেন।
বঙ্গভবনের শপথ অনুষ্ঠানে আমি, আমার সহকর্মী রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, কুমার শংকর হাজরা, আলী তারেক, গাজী মনসুর, ফরিদ উদ্দিন আহমদ সহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলাম। সেখানে কেবিনেট সেক্রেটারি এইচ টি ইমাম হাসিমুখে সানন্দে সকলকে বসাচ্ছিলেন এবং আগত সকলকে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সাথে গর্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। খুনি মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনার সময় তিনি তাকে শপথের পূর্বে মহামান্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণের অনুরোধ করছেন। সেখানে উপস্থিত সকলেই দেখলেন যে, তিনি এবং মাহবুব উল আলম চাষী মোশতাকের ডানহাত হিসেবে একসাথে চলাচল করছেন এবং একসাথে কাজ করছেন”
আমিন সাহেব কি এসব জানেন? নাকি জানেন না? নাকি জেনেও না জানার ভান করে বসে রয়েছেন? নাকি বললে চাকরী থাকবে না?
এই ছাড়াও আমিন সাহেব কেন বলেন না মোশতাকের মন্ত্রীসভার মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজী ঠিক কিভাবে আওয়ামীলীগের এম পি নির্বাচিত হয়েছিলো শেখ হাসিনার আমলে? কিংবা রাজাকার ফায়েজুল হক কিভাবে আওয়ামীলীগ সরকারের পাটমন্ত্রী হয়েছিলেন?
কেন তিনি বলেন না যে মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুরের শান্তি কমিটি সদস্য নুরু মিয়ার সন্তান খন্দকার মোশাররফ কেন আজকে এল জি আর ডি মন্ত্রী? প্রধান মন্ত্রীর বেয়াই বলেই কি তিনি মন্ত্রী? নাকি শান্তি কমিটি কোটায় একটা সিট ছিলো এই মন্ত্রীসভাতে?
১৯৮৭ বা ৮৮ এর দিকে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফীর অর্থে ফ্রিডম পার্টি বহুদিন দিনানুপাত করে। এই গাদ্দাফীর টাকাতে এবং দেশীয় আরো খুনীদের সংস্থানে এবং সর্বপোরি সম্পূর্ণভাবে এরশাদের সার্বিক তত্বাবধানে ফ্রিডম পার্টি গঠিত হয়। এদের মুখপাত্র পত্রিকা ছিলো দৈনিক মিল্লাত যেটার সম্পাদক ছিলো আমার শ্বশুর।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে এরশাদ ফ্রিডম পার্টিকে প্রমোট করলো, এই যে তলে তলে ফ্রিডম পার্টির এই গড়ে ওঠা এরশাদের হাত ধরে, এই এরশাদ ঠিক কিভাবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়?
আমার শ্বশুর এক সময় বাংলাদেশ এডিটর কাউন্সিলের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন দুইবার। এই দুইবারই শেখ সেলিম আমার শ্বশুরকে যথাসাধ্য সাহায্য ও সমর্থন দিয়েছিলেন বলে আমি জানি। এই তথ্য আমি জানতে পেরে বিষ্মিত হয়েছিলাম এবং খানিকটা কৌতুকবোধ হওয়ায়, হেসেছিলাম। আজও হাসি।
ঠিক এই কারনে কি প্রভাষ আমিনের কোন শংকা হয় না? যদি না হয় তাহলে আমার জানার ইচ্ছে, কেন হয় না? কেন এমন সিলেক্টিভ শংকা? সিলেটিভ উদ্বিগ্নতা?
আমার তো বরং শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা ছাড়া বাকি সবাইকে নিয়েই শংকা হয়। আমার তো মনে হয় সুযোগ পেলেই তার আশে পাশের এই ডলফিনের মত সাদা কালো পোষাকপরা লোকগুলোই এই দুই বোনকে খুন করে রেখে চলে যাবে।
আমি তো প্রধানমন্ত্রীর আশে পাশে দেখি খুনী, বদমাইশ, চাটুকার, স্তাবক আর জিব লকলক করা কিছু সাংবাদিকদের। এই ছাড়া তো আমার আর কিছুই চোখে পড়ে না।
আমার তো মনে হয় পিপলস পার্টি অফ বাংলাদেশ কিংবা বি এন পি নয়, আওয়ামীলীগের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে আওয়ামী ধ্বংসের বিষ।
এবার আসি দ্বিতীয় প্রসঙ্গ নিয়ে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এর সাথে প্রধানমন্ত্রীর সংলাপের সময় সেখানে চাটুকার আর স্বার্থলোভী নেতাদের সাথে শেখ হাসিনার যে কথপোকথন দৈনিক সমকালের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছিলো সেটি আমি আমার ফেসবুকে দিয়েছি।
ফেসবুকে দেবার পর একদল লোক আমাকে প্রশ্ন করেছে, প্রধানমন্ত্রী এমন ঔদ্ধত্য নিয়ে এমন “মানীগুনী” ব্যাক্তিদের সাথে কেন কথা বলবে? কিসের তাঁর এত অহংকার? আর কেনই বা এই ব্যাক্তিগত সংলাপ বা কথন প্রকাশ পাবে?
আমি এইসব প্রশ্ন শুনে হাসি। হাসি ছাড়া আর কি কিছু করবার রয়েছে?
বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের সাথে জিয়াউদ্দিনের ব্যাক্তিগত স্কাইপি কথপোকথন যখন প্রকাশিত হয়েছিলো তখন এই একই লোকগুলো সেই কথপোকথনকে স্বাগত জানিয়ে ফেসবুকে এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাকে নিয়ে কটুক্তি করেছিলো।
ব্যাক্তিগত কথপোকথনের এই যে প্রকাশের ধারা, সেটি তখন থেকেই প্রবাহিত হচ্ছে। আমরা সাঈদী হুজুরের লইট্টা মাছের গল্প শুনেছি, আমরা এম কে আনোয়ারের গল্প শুনেছি, মির্জা আব্বাস, খোকা, জাফরুল্লাহ,মান্নার ভাইবারের গল্প শুনেছি। আমরা এমনকি শেখ হাসিনা ও খালেদার কথপকথনও শুনেছি। কিছু আর বাদ থাকেনি।
তো স্কাইপি কথপোকথন নিয়ে যারা করতালি বাজিয়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন, “সত্য প্রকাশিত হোক”, এই বক্তব্য তুলে ধরে, তারা ঠিক কোন মুখে অন্য প্রকাশিত সংলাপ নিয়ে অসভ্যতার কিংবা অভব্যতার কথা বলে?
আমি জানতে চাই, ঠিক কোন মুখে?
এই যে আপনারা বেকায়দায় পড়লে হঠাৎ হঠাৎ সুশীল হয়ে ওঠেন, এই মানিকের চিপাতে পড়ে হঠাৎ হঠাৎ আপনারা ভদ্রলোক হয়ে ওঠেন, এটা আমাকে পৈশাচিক আনন্দ দেয়, একেই বলে পলিটিক্স অফ কনভেনিয়েন্ট। অর্থ্যাৎ নিজের সুবিধামত ভালো আর খারাপের ভেদাভেদ বা সংগা বের করা।
হাসিনা যাদের সেদিন ক্র্যাক করে চেপে ধরেছিলো এদের প্রত্যেকেই হচ্ছে পুরানা পাপী। শেখ হাসিনা এগুলোর সব ক’টাকে রগে রগে চেনেন। হাড়ে মজ্জায় চেনেন। এদের প্রত্যেকেই আওয়ামীলীগের সুবিধাভোগী ছিলো, এরা প্রত্যেকেই ছিলো আওয়ামীলীগের আদাবাটা খাওয়া বদমাশ। এখন দল থেকে বের হয়েই হাসিনাকে জাপটে ধরতে চায়। সুতরাং হাসিনা কেন এদের ছেড়ে কথা বলবেন?
কেন বলবেন? কিসের জন্য বলবেন?
হাসিনা এদের প্রত্যেকটাকে ধরে ধরে যে নাকানি চুবানি খাইয়েছেন, অত্যন্ত সঠিক কাজটা করেছেন। এই কাজের জন্য হাসিনা পুরষ্কার প্রাপ্যের কাজ করেছেন।
যেই মান্না একদিন দেশ নিয়ে ভাবতো, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভাবতো। যে মান্না একদিন ছাত্র অবস্থায় সমাজতন্ত্রের বুলি কপচাতো, সেই মান্না এখন রাজাকারের জননী খালেদাকে জান দিয়ে মুক্ত করতে চায়?
আর সেটি জানতে পেরে হাসিনা মান্নাকে ধরেছে বলে আপনাদের গায়ে এসে লেগেছে এখন? আসলে লাগবেই তো। খালেদার ছাল লুকিয়ে আপনারা এখন ঐক্যফ্রন্টের ছাল গায়ে দিয়েছেন। আদর্শটা তো আপনাদের ঐ একটাই।
আমি ব্যাক্তিগতভাবে গত পাঁচ বছরে আওয়ামীলীগের এই লুটপাট, বাক-স্বাধীনতাতে হস্তক্ষেপ আর গুম রাজনীতি দেখে বিষাদগ্রস্থ ছিলাম এবং আছিও।
আমার হৃদয়ের দল, আমার ভালোবাসার দল আওয়ামীলীগের এই পতন আমাকে প্রতি নিয়ত কষ্ট দেয়, ভেতরটা দগ্ধ করে। আমি অসংখ্যবার আমার কষ্টের কথা, আমার ক্রোধের কথা ফেসবুকে বলেছি, টিভিতে টকশোতে গিয়ে বলেছি, পত্রিকার কলামে বলেছি, রেডিওর অনুষ্ঠানে বলেছি।
আমি মনে প্রাণে চাই আওয়ামীলীগের এই রাজনীতির পাল্টা রাজনীতি দাঁড়াক আর সেটি হোক বঙ্গবন্ধুকে সূপ্রীম লিডার মেনে এবং তাঁকে সম্পূর্ণ স্বীকার করবার ও আয়ত্ব করবার মাধ্যমে।
আমি চাই মুক্তিযুদ্ধকে যারা ধারন করতে পারবে বুকের ভেতর তারাই এই বাংলাদেশে করতে পারবে রাজনীতি। আমি চাই বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সহযোগী, বেনিফিশিয়ারী, স্তাবকদের কাছ থেকে দূরে থাকুক রাজনীতি।
শিক্ষিত তরুন, যুবা যারা এই দেশের মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োগ করবে, তারাই করুক রাজনীতি। আর আওয়ামীলীগের আদর্শের প্রতিপক্ষ হিসেবে তাঁরাই একমাত্র ফ্রন্ট করতে পারে, ঐক্য করতে পারে।
পঁচে যাওয়া মান্না, জাফরুল্লাহ, রব কিংবা কাদের সিদ্দিকীরা নয়।