এক
গত কয়েকমাস আগে দেশের একজন জনপ্রিয় ও গুনী সংগীত শিল্পী, সুরকার ও লেখক তার ফেসবুকে মাহফুজুর রহমান সাহেবের অনেক সমাজ সেবামূলক কাজ কর্মের তালিকা বলে বলছেন, যে বা যারা মাহফুজ সাহেবের সংগীত শিল্পী হওয়াতে তার সমালোচনা করছেন তারা যেন সমালোচনা করার আগে মাহফুজ সাহেবের মতো সামাজিক কল্যানমুলক কাজ করে আসেন, তারপরে সমালোচনা করেন!
শেষে অবশ্য তিনি জানিয়েছেন যে, তিনি এ টি এন এর সাথে কোন কাজ করছেন না যাতে মনে হতে পারে তিনি তৈলমর্দন করছেন।
একজন সংগীত শিল্পী হয়ে, মাহফুজুর রহমানের সামাজিক কর্মকান্ডের ভিত্তিতে তার সংগীত শিল্পী স্বত্বা কে জাস্টিফাই করা আদৌ তিনি বিশ্বাস করেন কিনা জানতে চেয়েছিলাম বিনীতভাবে।
না, তিনি আমাকে আনফ্রেন্ড বা ব্লক করেননি, তবে তিনি আরেকটি দারুন মজার এবং প্রবাসী দের বিরুদ্ধে বহুল ব্যবহৃত সবচেয়ে সস্তা অস্ত্র টি ব্যাবহার করেছেন।
তিনি জানতে চেয়েছিলেন আমি দেশের জন্য কি করেছি? যেহেতু দেশের ভালো কিছু চাওয়া ছাড়া বস্তুগত কিছু করতে পারিনি, তাই তাকে জানালাম যে কিছুই না!
তবে তাকে আর ফলো করার ইচ্ছে হয়নি, তাই আর কথা বাড়াই নি।
দুই
আগামী ৩০ শে ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন, এটা পুরানো খবর।
নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন পত্র কে কে কিনেছেন সেই হিসাবে না গিয়ে কে কে কিনেন নি সেটা মনে হয় সহজ হিসাব! এদের মধ্যে মাশরাফি বিন মর্তুজা আর হিরো আলম হচ্ছেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
মাশরাফি কে নিয়ে আগে একটা লেখায় বলেছি, আজকে আলম সাহেব কে নিয়ে একটু বলি।
অনেকেই ব্যাপারটা মজা হিসেবে নিয়েছেন, অনেকে এটাকে তার অধিকার বলে সহমত প্রকাশ করেছেন আবার অনেকে এর বিরোধী মত প্রকাশ করেছেন। ব্যাক্তিগতভাবে আমি এর দারুণ বিরোধী, কারনটা ব্যাখ্যা করছি একটু পরেই – তার আগে অল্প কিছু কথা বলে নেয়া প্রয়োজন।
আলম সাহেবের ব্যাক্তিগত পরিশ্রম, নিসঠা এবং চেস্টার প্রতি আমার দারুন এক ইতিবাচক এবং ভালোলাগা কাজ করে যেটা সমাজের অনেক প্রতিস্ঠিত মানুষের জন্য করেনা।
আর আমাদের মন্ত্রী থেকে চেয়ারম্যান প্রায় সবাই সমাজের জাগতিক সকল অপকর্মের সাথে জড়িত, সেখানে এই মানুষ টি অনেক ভালো অপশন হতে পারে।
উনার আর আমার চেহারা এবং আর্থিক অবস্থা প্রায় একই রকম হওয়ায় তা নিয়ে ও দ্বিমত করার কোন কারন ই নেই! পার্লামেন্ট মেম্বার হওয়ার জন্য চেহারা ও আর্থিক সংগতি কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।
উনার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং কথা বলার ধরন একটা বড় অন্তরায় হলেও এমন অযোগ্য লোক আমরা এর আগেও সংসদে দেখেছি, এখনো দেখছি, আমি নিশ্চত আগামী নির্বাচনে ও আমরা এমন অযোগ্য কিছু মানুষ আবারো সাংসদ হিসাবে দেখবো।
সব মিলিয়ে বলতে গেলে তার প্রতি আমার ব্যাক্তিগত কোন অনুযোগ নেই। সৃস্টিকর্তার সৃস্ট প্রতিটি মানুষের প্রতি আমার সম্মান আছে। কিন্তু তারপরও আমি চাইনা আলম সাহেব আমাদের দেশের একজন আইন প্রনেতা হোক।
তিন
(এবারে আসা যাক মূল কথায়) নিঃসন্দেহে মাহফুজুর রহমান এবং আলম সাহেব বাংলাদেশে এমন কি অনেক প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছে জনপ্রিয়। তাদের গানের এবং ভিডিও র ভিউজ সংখ্যা হিসাব করলে সেটা স্বীকার করতেই হবে।
এমনকি আলম সাহেবকে নিয়ে নাকি বলিউডে সিনেমা ও তৈরী হচ্ছে শীঘ্রই!! তাদের এই জনপ্রিয়তার জন্য মোটেই তাদের দোষারোপ করা যাবেনা।
মানুষ মাত্রেই স্বপ্ন থাকে সফলতার – জনপ্রিয়তার – অন্যের মধ্যে নিজের অস্তিত্ব কে জানান দেয়ার, নিজের কাজের মাধ্যমে নিজেকে অমর করে রাখার। এতে দোষের কিছু নেই বরং এটাই স্বাভাবিক।
তাছাড়া বিশ্বজুড়ে এখন চলছে নেগেটিভ প্রচারণার অদ্ভুত এক ট্রেন্ড, মানুষ পজেটিভ কোন প্রচারণা থেকে নেগেটিভ প্রচারণায় প্রভাবিত হয় অনেক বেশী।
আর নিজেদের স্বপ্ন পুরন করতে এই অতি সহজ ফর্মুলা টা ই ব্যবহার করেছেন মাহফুজ সাহেব – আলম সাহেব – চিনু ম্যাডাম সহ আরো অনেকেই ( ইউ টিউব খুললেই এদের উদ্ভট এবং সুস্থ মানুষের জন্য অরুচিকর জিনিস গুলো যে কেউ দেখতে পারবেন)।
আর আমরা এই হুযুগে মাতাল এবং প্রায় বিশাল অংশ অশিক্ষিত এক জাতি, আমাদের চিত্ত বিনোদনের অভাব বলে এদের এই অতি সস্তা গান – কমেডি – নাটক নামক অতি স্থুল আর নিম্ন রুচির এবং সেক্সুয়াল কন্টেন্ট সম্পুর্ণ অখাদ্য গুলো নিজের জ্ঞ্যাতসারে বা অজ্ঞ্যাতসারে গিলে এদের অনেকের গায়ে লাগিয়ে দিয়েছি “জনপ্রিয়” নামক ট্যাগ; আবার আমরা অনেকেই এদের নিয়ে ট্রল করতে গিয়ে এদের অনেকের প্রচারের কাজটা করে দিয়েছি!!
যদি বলি ঠিক এই জিনিসটা ই এরা চেয়েছিল তবে কি সেটা ভুল বলা হবে?
আর প্রচারেই যে পসার সেটা তো এখন হাতেনাতে ই দেখা যাচ্ছে!
প্রতিভাবান আর জনপ্রিয় হওয়ার মাঝে অনেক পার্থক্য আছে, সেটা আমরা অনেকেই বুঝিনা। মাহফুজ সাহেব – আলম সাহেব – চিনু ম্যাডাম এরা জনপ্রিয় ঠিকই কিন্তু এরা যেই মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়েছেন সেই মাধ্যমে যে এরা কেউ ই প্রতিভাবান নন সেটা বোধ করি সবাই একমত হবেন অন্তত সুস্থ রুচিশীল মানুষেরা
এই যে এদের মধ্যে একটা “সেন্স অফ ফলস হিরোইজম” আমরা ঢুকিয়ে দিয়েছি, এর দায় আমাদের সবার – আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।
একটা শিক্ষিত এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন সমাজ ব্যবস্থায় কাউকে এমন “মিথ্যা আশ্বাস” খুব একটা দেয়া হয়না, আর দেয়া হলেও সেটা একটা নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত, আমাদের মতো মাত্রা ছাড়ায় না।
আবেগের জায়গা থেকে একটু বের হয়ে এসে সত্যি করে বলুন তো নিজের কস্টের পয়সায় বিনোদন পেতে চাইলে কখনো মাহফুজ সাহেবের সংগীতানুষ্ঠানে যাবেন অথবা যাবেন আলম সাহেবের ছবি দেখতে?
উত্তর হচ্ছে যাবেন না।
কারন আপনি আমি সবাই জানি যে আমরা তাদের একটা মিথ্যা এবং ভুল চিত্র দিয়ে এই অবস্থায় নিয়ে এসেছি, যা একদমই অনুচিত।
অনেক সন্ত্রাসী, – লুটেরারা সংসদে গিয়েছেন, আছেন এবং আবারো যাবেন বলে যারা আলম সাহেবের মনোনয়ন কেনাটা এবং নির্বাচন করাটা কে জাস্টিফাই করতে চাচ্ছেন, তাদের বেলায় বলা যায় – শুধু আলম সাহেব না শিক্ষাগত ভাবে অন্ততপক্ষে অনার্স পাশ না করলে কাউকে মনোনয়ন পত্র কেনার যোগ্য বলেই বিবেচনা করা উচিত নয়।
নামমাত্র শিক্ষিত সাংসদদের দিয়ে চালিয়েই গত প্রায় ৩ দশকে দেশের যেই অবস্থা; একদম অশিক্ষিত লোক সংসদে এনে দেশটাকে গলা টিপে হত্যা করার পক্ষে আমি নই।
আর আমাদের মতো দেশগুলোতে কেবলমাত্র শিক্ষিত জনগোষ্ঠী দিয়েই এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব।
আলম সাহেবের চেস্টা – স্বপ্ন কে সম্মান করি কিন্তু তাকে এবং তার মতো অশিক্ষিত কাউকেই আমার দেশের একজন আইন প্রনেতা হিসাবে দেখতে চাই না, এমনকি এদের নিয়ে কোন ধরনের মিডিয়ার কোন ধরনের প্রচার না হওয়াটাও জরুরী, এতে করে যদি এদের এই নেগেটিভ প্রচারের রোগ টা সারে!!
অন্যথায় এদের দেখাদেখি আরো অনেক অকালকুষ্মাণ্ড কে এভাবে সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে যেমন উৎসাহ জোগাবে, তেমনি তারা একই ধারাবাহিকতায় দেশের আইন প্রনেতাও হতেও চাইবেন। যা কোনভাবেই একটি সুস্থ সমাজ ব্যবস্থায় কাম্য নয়।
তবে মিডিয়াতে ডেকে এনে আলম সাহেব কে অপমান করার পক্ষেও আমি নই, এটা এক ধরনের বর্নবাদী, চামচামি ও তোষামোদী আচরণ, মানসিক আস্থাহীনতামুলক সাংবাদিকতা এবং বর্তমান অনেক সাংবাদিকদের মানসিক দৈনতার প্রকাশ।
অন্তত এ থেকে হলেও আমাদের নেতাদের বোঝা উচিত, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কি করুন অবস্থা হয়েছে এবং এখন সময় হয়েছে সেই নষ্ট হয়ে যাওয়া ব্যবস্থা টা ঠিক করার, অন্যথায় একদিন এই দেশটি আর চলবে না, সমাজের শিক্ষিত মানুষ গুলো শুধু নিঃশ্বাস নিবে কিন্তু এউ বেচে থাকবেনা..