ফিলিস্তিনিদের জন্য ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দিতে মিসর-গাজা সীমান্ত খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ফিলিস্তিনিদের জন্য আসা জরুরি ত্রাণ মিসরীয় সীমান্তে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে। এদিকে ফিলিস্তিনিদের ঢল ঠেকাতে সীমান্তে সেনা মোতায়েন করেছে মিসর। দেশটি আশঙ্কা করছে, গাজার লাখো ফিলিস্তিনি শরণার্থীকে সিনাই মরুভূমিতে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে ইসরায়েল।
ফিলিস্তিনিদের জন্য আসা জরুরি ত্রাণ সহায়তা বিষয়ে করণীয় নিয়ে রবিবার মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তেহ আল সিসির সঙ্গে বৈঠকে বসেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। এরপরই তিনি জানান, মানবিক সহায়তার জন্য রাফাহ সীমান্ত আপাতত খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, এই গুরুত্বপূর্ণ সীমান্তটি সোমবার সকাল ৯টার দিকে কয়েক ঘণ্টার জন্য খুলে দেওয়া হয়।
এর আগে ত্রাণের গাড়িগুলোকে সীমান্তে সারিবদ্ধ অবস্থায় দেখা যায়। গাজায় ইসরায়েলের সর্বাত্মক অবরোধ আরোপে সীমান্ত দিয়ে পানি, জ্বালানি ও খাদ্য সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। উপত্যকাটিতে মানবিক পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০০৭ সাল থেকে গাজাকে ইসরায়েল অবরুদ্ধ করে রাখার পর আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর অনেকটা নির্ভরশীল এখানকার ফিলিস্তিনিরা।
এদিকে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার সঙ্গে রাফাহ সীমান্ত ক্রসিংয়ে সামরিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে মিসর। দেশটি আশঙ্কা করছে, গাজার লাখো ফিলিস্তিনি শরণার্থীকে সিনাই মরুভূমিতে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে ইসরায়েল। কায়রো বলেছে, নিজেদের বাড়ি থেকে এত বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনিকে উচ্ছেদ করা হবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং মিসরের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। ফিলিস্তিনিরা আশঙ্কা করছেন, একবার উচ্ছেদের পর অন্য আরব দেশে শরণার্থী হয়ে গেলে আর কখনো নিজের বাড়িতে ফিরতে পারবেন না তারা। গাজায় কয়েক দিন ধরে বিমান হামলা চালানো অব্যাহত রাখা ইসরায়েলের কূটনীতিকরা স্বীকার করছেন না যে, গাজার ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করা তাদের লক্ষ্য। তবে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত বলেছেন, তাদের পরিকল্পনা হলো সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। অপর এক মন্ত্রী গিদিয়ন সার বলেছেন, যুদ্ধের শেষে গাজাকে আগের চেয়ে ছোট হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে দায়িত্ব পালন করা সাবেক ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত ড্যানি আয়ালন বলেন, মিসরের উচিত সাময়িক সময়ের জন্য শরণার্থীদের গ্রহণ করা। সিনাই মরুভূমিতে অনেক জায়গা রয়েছে। এটি একেবারে গাজার পাশে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ইসরায়েল কর্তৃক গাজার ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের সম্ভাব্যতা নিয়ে রোববার সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে আলোচনা করেন। ঐ দিনই তার কায়রো সফরে যাওয়ার কথা। তবে সব আরব দেশই এমন উদ্যোগের বিরোধিতা করেছে। তারা সতর্ক করে বলেছে, এতে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু হতে পারে। কিন্তু যদি উচ্ছেদ ঘটে যায় তাহলে হয়তো তাদের সামনে শরণার্থী শিবির স্থাপনে তহবিল দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
১৯৪৮ সালে উচ্ছেদ হওয়া বেশির ভাগ ফিলিস্তিনিদের আত্মীয় গাজায় রয়েছেন। তাদের আশঙ্কা আরেকবার গণ উচ্ছেদের ফলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটতে পারে। বৃহস্পতিবার মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি বলেন, গাজার ফিলিস্তিনিদের অবশ্যই তাদের ভূমিতে অটল থাকতে হবে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান বলেছেন, মিসরের সঙ্গে তিনি সম্পূর্ণ একমত।
কায়রোতে তিনি বলেন, আমি আরও একবার ইসরায়েলকে আহ্বান জানাচ্ছি আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার জন্য। ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আমরা মিসরে তাদের স্থানান্তর কখনো সমর্থন করব না।
মিশরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেহ শৌকরি শনিবার জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বায়েরবকের সঙ্গে বৈঠকে জোর দিয়ে বলেছেন, গাজায় আটকে পড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি নাগরিকদের রাফাহ ক্রসিং দিয়ে মিসরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত ইসরায়েল গাজায় ত্রাণ বহরের প্রবেশের অনুমতি দেবে।
মিসরের হাতে দরকষাকষির যেসব হাতিয়ার রয়েছে এটি সেগুলোর একটি। গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের ঢল মিসরে প্রবেশ এড়াতে চায় কায়রো। একই সঙ্গে বেশ কিছু জরুরি উদ্যোগও গ্রহণ করছে তারা। তারা দাবি করছে, অল্প সংখ্যক শরণার্থীদের জন্য এই পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বড় আকারের শরণার্থী শিবির গড়ে তোলার বিরুদ্ধে তারা। তাদের আশঙ্কা, এসব শিবিরে সিসি ও ইসরায়েলি বিরোধী ব্যক্তিরা অবস্থান নিতে পারে। সিনাই উপদ্বীপে ইসলামি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে মিসরীয় সেনারা। কয়েক দশকের সংঘাতের পর ১৯৭৯ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে মিসর। এরপর থেকে দুই দেশ পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ধারণা করা হয় বিভিন্ন দেশে বসবাসরত ফিলিস্তিনি অভিবাসীদের সংখ্যা ৬০ লাখের বেশি। এর মধ্যে জর্ডানে ৩০ লাখ ও লেবাননে ৪ লাখের মতো ফিলিস্তিনি রয়েছে। মিশরে এই সংখ্যা অনেক কম। ১৯৭৮ সালের ক্যাম্প ডেভিড শান্তি চুক্তির পর থেকে মিসরে খুব কম ফিলিস্তিনি শরণার্থী বা নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত। তবে মিসর যে কিছু মাত্রায় শরণার্থীদের জায়গা দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে তার ইঙ্গিত দিয়েছেন সিনাইয়ের উত্তরাঞ্চলীয় গভর্নর জেনারেল মোহামেদ আবদেল-ফাদিল শৌশা।