ইরানের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর যখন জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তখন তেহরান সম্ভবত উত্তরে কঠোর পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। এর মধ্যে রয়েছে পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) থেকে সরে আসার সম্ভাবনা। এই পরিস্থিতিতে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে। মিডল ইস্ট আইয়ে প্রকাশিত কলামে ইরানি-কানাডীয় বিশ্লেষক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক শাহির শাহিদ সালেস লিখেছেন, কিছু মাসের অচলাবস্থার পরে অবশেষে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি (যাকে মূলত ‘ই-থ্রি’ নামে পরিচিত) ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বাহের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। গত বৃহস্পতিবার তারা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আনুষ্ঠানিক নোটিশ পাঠিয়ে জোর দিয়ে বলেছে, তারা ‘কূটনৈতিক সমাধান’ চায়, এবং পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে সমস্যার সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২২৩১ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী, যদি মনে হয় ইরান বড় ধরনের অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে, তবে বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে জানানো হবে এবং ‘স্ন্যাপব্যাক প্রক্রিয়া’ চালু হবে। এই প্রক্রিয়া চালু হলে, ৩০ দিনের মধ্যে পুরো নিষেধাজ্ঞাগুলো ফিরে আসবে, যার মধ্যে রয়েছে অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র, জাহাজ চলাচল, কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা। এসব নিষেধাজ্ঞা ভেটোপ্রতিরোধী, অর্থাৎ এককভাবে কোনো দেশ এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে না। সম্প্রতি ইরান-ইউরোপীয় দেশগুলোর আলোচনা ও আলোচকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ই-থ্রি তিনটি শর্ত দিয়েছিল, যাতে ‘স্ন্যাপব্যাক’ কার্যকর না হয়। শর্তগুলো হলো: ইরান যেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় ফিরে আসে; আইআরজিসি আবার ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোতে প্রবেশাধিকার পায়; এবং ইরানে যে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে, তার পুরো হিসাব দিতে হবে। তবে এই নিষেধাজ্ঞাগুলো ইরানের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে তিনটি—তেল-গ্যাস খাতে নতুন বিনিয়োগ, আইআরজিসির ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা এবং ১৬৯৬ নম্বর প্রস্তাবের পুনর্বহাল, যা ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে বাধ্য করে। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের বিষয়টি পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে অচলাবস্থার কেন্দ্রে রয়েছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকেও বড় ক্ষতি হচ্ছে। তেল-গ্যাস খাত ইরানের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হলেও উৎপাদন কমে যাচ্ছে, প্রযুক্তি পুরোনো হচ্ছে, এবং দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, সাউথ পার্স গ্যাসক্ষেত্রের জ্বালানি প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে ব্যবহৃত হয়। তবে চাপ কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সংকট বেড়েছে। জ্বালানিমন্ত্রী জানাচ্ছেন, আগামী চার বছরে প্রতি বছর ১৯ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন, কিন্তু মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ভয়ে অন্য দেশগুলো অর্থ ঢালছে না। রাশিয়া ও চীন এ অর্থ দিতে পারলেও, তারা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মেয়াদে বাধার সম্মুখীন হতে পারে। আইআরজিসির ওপর নিষেধাজ্ঞা অতিসংঘের জন্য আরও বড় আঘাত, কারণ তারা দেশের বেশিরভাগ অর্থনীতি ও সামরিক সুবিধাগুলোর নিয়ন্ত্রণ করে। চীন ইরানের মোট তেলের প্রায় ৯০ শতাংশ কেনে, কিন্তু আইআরজিসি এর প্রায় অর্ধেক নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ, চীনও যদি রপ্তানি কমাতে বা বন্ধ করতে বাধ্য হয়, তাহলে পুরো তেল বাণিজ্যঝুঁকি মোকাবিলা করতে হবে। এই নিষেধাজ্ঞার বাস্তবায়নে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমবে, রিয়াল দুর্বল হবে, এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাবে। রাজনৈতিক অবস্থাও ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ আইআরজিসির ওপর নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও একঘরে করবে, এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নও তাদের ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করতে পারে। ইরানের শাসনব্যবস্থার ওপর এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, বিশেষ করে এমন পরিস্থিতিতে যা দেশটির অস্তিত্বের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি আসতে পারে ২০০৬ সালে গৃহীত ১৬৯৬ নম্বর প্রস্তাব থেকে, যেখানে ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ পুরোপুরি বন্ধ করতে বলা হয়েছিল। এটি তাদের গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমও বন্ধ করতে বাধ্য করে। কিন্তু ইরান সবসময় দাবি করেছে, এটি তাদের পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তির অধিকার। রুশ ও চীনও এই প্রস্তাবের পক্ষে ছিল। এর ফলে ইরানের কৌশলগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ভেঙে যাবে, এবং ২০১১ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত একটিই বছরেও নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার। এ পরিস্থিতিতে, সরকার অর্থনীতি ও নিরাপত্তার জন্য এগিয়ে যেতে বাধ্য, তবে এর ফলে দেশের মধ্যে ক্ষোভ ও বিক্ষোভ আরও জোরদার হতে পারে। স্ন্যাপব্যাকের ফল স্বরূপ, অর্থনীতি ও পারমাণবিক কর্মসূচির পাশাপাশি রাজনৈতিক ও আদর্শিক স্থিতিশীলতাও চূর্ণবিচূর্ণ হতে পারে। অন্যদিকে, ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করে বলেছে, এ ধরনের পদক্ষেপের আইনি বা নৈতিক ভিত্তি নেই। তবে ইরান ইতিমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা এনপিটি থেকে বের হয়ে যাওয়ার এবং আইআরজিসির সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ করায় প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই সপ্তাহে উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী কাজেম ঘারিবাবাদি সতর্ক করে বলেছেন, ‘যদি স্ন্যাপব্যাকের উদ্যোগ কার্যকর হয়, তবে এই পরিস্থিতিতে আমাদের সহযোগিতা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে।’ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যদি ইরান এনপিটি থেকে সরে যায় বা আইআরজিসির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে, তবে পারমাণবিক কর্মসূচি গোপন রূপ নেবে। এতে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা আরও গাঢ় হবে এবং পশ্চিমাদের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা দেবে। সবচেয়ে ভয়ংকর সম্ভাবনা হলো, ইসরায়েলের ওপর ভয়ংকর হামলার ঝুঁকি এবং দেশটির প্রতিক্রিয়ায় পুরো আঞ্চলিক সংঘাতের অবতরণ। ইসরায়েল যদি ইরানে আঘাত করে, তবে এর ফলাফল ভয়ঙ্কর হতে পারে, যা পূর্বের যেকোনো সংঘাতকে পেছনে ফেলে দিতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে, ইরান সরাসরি মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালাতে পারে বা হরমুজ প্রণালী অচল করে দিতে পারে, যার ফলে বিশ্ববাজারে তেলের সরবরাহ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে। এই পরিস্থিতি যুদ্ধের স্তরকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলতে পারে। এ পরিস্থিতি এড়ানোর একমাত্র পথ হচ্ছে, ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে বিধিনিষেধ মেনে নেওয়া। এছাড়া, বিশ্লেষকরা মনে করেন, সংকট সমাধানে একমাত্র উপায় হলো, ইরানের সমৃদ্ধকরণের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া, এবং এই বিষয়টি অন্তর্বর্তীকালীন সমঝোতার মাধ্যমে সবাই মেনে নেওয়া। যদি এ বিষয়টি না মানা হয়, তাহলে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা এবং সংঘাতের সম্ভাবনা মারাত্মকভাবে বেড়ে যেতে পারে।