আজ ১৮ অক্টোবর, বাংলাদেশের কিংবদন্তি রক সংগীতশিল্পী, গিটার জাদুকর ও সংগীত পরিচালক, প্রিয়জনের কাছে আইয়ুব বাচ্চু নামে পরিচিত, এর সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী। এই মহাতারকা কখনোই সংগীতজগতে আলোর মুখ দেখানো থেকে দূরে থাকবেন না এবং তার অসাধারণ সৃষ্টি আজও আমাদের হৃদয়ে অমলিন থাকছে।
বাঙালির সংগীত ইতিহাসে আইয়ুব বাচ্চুর অবদান অসাধারণ। তিনি বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের এক অমূল্য রত্ন, যার গিটার সদৃশ স্বরলিপি আজও গীতিময় হয়ে ওঠে লাখো শ্রোতার হৃদয়ে। তার মৃত্যু আমাদের কাছে এক শূন্যতা সৃষ্টি করলেও, তার প্রতিভা ও কাজের প্রভাব চিরকাল অম্লান থাকবে। তাঁর জন্য আমরা আত্মিক শ্রদ্ধা জানাই এবং পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করি। এই কীর্তিমান শিল্পীর অবদান কেবল পরিচিতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তার অনুপ্রেরণা আমাদের উদ্দীপিত করে চলবে।
আমার ব্যক্তিগত জীবনে আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে ২০১০ সালে, যখন আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক বিশাল কনসার্টের আয়োজন করেছিলাম। এই ‘বিজয়ের কনসার্ট’ ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ সংবর্ধনা যেখানে দেশের শীর্ষ ব্যান্ডদল এলআরবি, রকস্টার, মিলা, নির্ঝর ও চট্টগ্রামের অপু অংশগ্রহণ করে প্রায় ৫০,০০০ দর্শকের উপভোগ্যতা অর্জন করে।
এই ঐতিহাসিক আয়োজনে প্রধান সহযোদ্ধা ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন এবং স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘গুণীজন সংবর্ধনা পরিষদ’। বিশেষ কৃতজ্ঞতা মাননীয় জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নানসহ পুলিশ সুপার মোখলেছুর রহমান ও জামিল আহমদ, যাঁদের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া এই আয়োজন সফল হওয়া অসম্ভব। এছাড়াও, স্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বন্ধু-सাংবাদিক ও প্রবাসীদের অবদান এই কনসার্টের সফলতার পেছনে ছিল অমূল্য। যার মূল চালিকা শক্তি ছিল জাতীয় মানের কারিগর ফরহাদ হোসেন।
পরের বছর ‘বিজয়ানন্দ’ নামে আরো বড় পরিসরে বিজয়ের মাসে সেই কনসার্টটি অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে এলআরবি, দলছুট ও হৃদয় খানসহ আরও অনেক বিশিষ্ট শিল্পীর অংশগ্রহণ ছিল। এই দু’টি কনসার্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর মনে এক চিরস্মরণীয় স্মৃতি।
প্রতিটি মূল এই সাফল্যের পেছনে ছিল বাচ্চু ভাইয়ের অকুণ্ঠ সহযোগিতা। তার অনুদান ও সহযোাগিতায় জেলা শহরে টিকিটবিহীন ওপেন-এয়ার কনসার্ট আয়োজন সম্ভব হয়েছিল। আমি সেই দিনগুলো মনে করে খুব গর্ববোধ করি এবং তার জন্য চিরকাল কৃতজ্ঞ। এরপর থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, এবি কিচেনসহ নানা ক্ষেত্রে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
আজ ১৮ অক্টোবর—মহান এই শিল্পীর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে, আমরা তার স্মৃতি উৎসর্গ করে বিভিন্ন স্মরণসভার আয়োজন করছি। এই স্মরণসভায় আমি প্রতিবারের মতো অংশগ্রহণ করি, কারণ এই গুণী মানুষটির জন্মদিন বা প্রয়াণ দিবসের স্মৃতি আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। প্রিয় তার স্ত্রী চন্দনা ভাবীকে আমি আন্তরিক প্রশংসা জানাতে চাই, যিনি আজও তার ভালোবাসা অটুট রেখেছেন একাকী।
আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন খোলা আকাশের মতো বিশাল, সমুদ্রের মতো গভীর। তার চলে যাওয়ায় সংগীতাঙ্গন কখনোই সম্পূর্ণভাবে পূরণ হতে পারে না। যখন আমি এই লেখাটি লিখছি, তখন লক্ষ্মীপুর সার্কিট হাউসের একটি কনভেনশন সেন্টারে রাত ২:৩০ মিনিট। আমি বাপ্পী খানের কথা থেকে একজন গীতিকার হিসেবে অনুপ্রেরণা পাচ্ছি—‘এখন অনেক রাত, খোলা আকাশের নিচে, জীবনের অনেক আয়োজন, তাই আমি বসে আছি, দরজার ওপাশে…’
বাচ্চুর কালজয়ী গান— “সেই তুমি (চলো বদলে যাই)”, “রূপালী গিটার”, “সাড়ে তিন হাত মাটি”, “উড়াল দেবো আকাশে”, “মেয়ে”, “চাঁদ মামা”, “বাংলাদেশ”, “মাধবী”, “হকার”— এগুলো আজও হৃদয়কে স্পর্শ করে, চোখে জল এনে দেয়। এই গানগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্মের হৃদয়ে চিরঅনির্বাণ থাকবে, যতদিন বাংলার সংগীতপ্রেমীরা তাদের অস্বচ্ছন্দে গান গেয়ে যাবেন।
বিশ্বের এই মহাকাব্যিক শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর স্মৃতি উচিত আমাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও যথাযথভাবে রক্ষা ও উদযাপন করা। আমি বারবার বলছি, ‘‘বাচ্চু ভাইয়ের নামে ‘আইয়ুব বাচ্চু মিউজিক অ্যাওয়ার্ড’ চালু করা উচিত।’’ আমি ও আমার প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এই উদ্যোগে পাশে থাকব বলে অঙ্গীকার করছি।
একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি বলতে চাই, আইয়ুব বাচ্চু ভাই অকালে চলে গেছেন, তবে তার অবদান কালের এক অনন্য নিদর্শন। দেশের সংগীতের জন্য তার আরও অধিক দিন বেঁচে থাকা প্রয়োজন ছিল। সকল শিল্পীর এখনই সবার স্বাস্থ্য সচেতন হওয়া দুরুত্বহীন। নিয়মিত স্বাস্থ验পরীক্ষা, ধূমপান ও অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস বর্জন এবং প্রতিদিন অন্তত ৪০ মিনিট হাঁটাহাঁটি প্রয়োজন।
আমাদের এই স্বাস্থ্যসচেতনতা ও যত্নে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সবসময় পাশে থাকবে— এই অঙ্গীকার করি।
অন্তত এতটুকুই বলতে চাই, আইয়ুব বাচ্চু থাকবে কোটি প্রাণে, রূপালী গিটার ছয়টি তারে বাজবে অনির্বচনীয় স্মৃতি রূপে। তার রেখে যাওয়া শিল্পকীর্তি চিরকাল আমাদের মননে, সংগীতাঙ্গনে বেঁচে থাকবে।
লেখক: ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্তী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা ইউনিভার্সেল মেডিকেল সার্ভিসেস লিমিটেড, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।