নাটোরের লক্ষ্মীপুর-খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামে অবস্থিত দেশের একমাত্র ঔষধি পল্লীটি এখন একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে পরিচিত। এই ভেষজ পল্লীতে প্রতিদিন আসছেন অসংখ্য দর্শনার্থী, যারা এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ভেষজ চাষাবাদ দেখে মুগ্ধ হন এবং পর্যটন উপকৃত হন। এই গুচ্ছের গ্রামে বছরে অ্যালোভেরার উৎপাদন হয় প্রায় ১৫ হাজার টন, এছাড়া শিমুল মূল, অশ্বগন্ধা, মিশ্রি দানা, বিটরুট, রোজেলা ও শতমূলসহ মোট ১৪০ ধরনের ভেষজের উৎপাদন হয়। এই ভেষজের বাজারমূল্য অন্তত শত কোটি টাকার বেশি, যা স্থানীয় অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
নাটোর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর-খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এই এলাকার অবস্থান প্রতিটি গ্রামে ক্ষুদ্র আড়ং বা আবাদি জমিতে। ইউনিয়নের প্রধান সড়কের পাশাপাশি চোখে পড়ে সারিবদ্ধভাবে বাড়ির আনাচে-কানাচে, রাস্তার পাশে, নদীর পাড়ে রকমারি ভেষজ উদ্ভিদ। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন হলো অ্যালোভেরা গাছ, যা দেখে সবাই হাসিতে মুখভরে ওঠেন।
জানা গেছে, ১৯৯৫ সালে এখানকার আফাজ পাগলা কবিরাজি কাজে ব্যবহারের জন্য স্বউদ্যোগে ভেষজ উদ্ভিদ চাষ শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে এই চাষের প্রসার ঘটে এবং সমগ্র গ্রামে এই উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়ে, যা সারা ইউনিয়নজুড়ে বিস্তৃত। এখন এই গ্রামে শুধু আবাদি জমিই নয়, ইহার সঙ্গে জড়িত গ্রামের প্রতিটি বাড়ির আঙিনাও ভেষজ গাছের বহর দেখে মন ভরে যায়। তবে শোভা ও চাহনিে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে অ্যালোভেরা গাছ।
নাটোর সদর উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, এই এলাকায় মোট ১৪০ প্রকার ভেষজ উদ্ভিদ জন্মে। এর মধ্যে অ্যালোভেরা ছাড়াও রয়েছে শিমুল মূল, অশ্বগন্ধা, মিশ্রি দানা, বিটরুট, রোজেলা ও শতমূল। মোট ১৫৫ হেক্টর জমিতে এই সব ভেষজ চাষ হচ্ছে, এগুলোর উৎপাদন দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে ৭০ হেক্টরে অ্যালোভেরার চাষের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৩০ হাজার টন পাতার উৎপাদন হয়। শিমুল মূল থেকে বছরে প্রায় ১২০০ টন প্রস্তুত হয়, আর বিটরুট ও মিশ্রি দানা থেকে বছরে প্রতিটি ৫০ টন করে উৎপাদন হচ্ছে। অশ্বগন্ধা বছরে ১২ টন মতো উৎপাদন হয়। এই সমস্ত ভেষজের সঙ্গে জড়িত মোট ২০০০ জন কৃষক, যারা এই চাষাবাদে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে থাকেন।
অ্যালোভেরার চাষের জন্য বর্ষার শেষে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে এক বিঘা জমিতে প্রায় ১০ হাজার চারা রোপণ করা হয়। এই আবাদি জমি থেকে পরবর্তী দুই বছর সহজে অ্যালোভেরার পাতার যোগান দেয়া যায়। রোপণের তিন মাসের মধ্যে পাতার সংগ্রহ শুরু হয় এবং সেচ, সার, কীটনাশক ও প্রয়োজনীয় উপাদান ব্যবহার করে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে এই চাষাবাদ চালানো হয়। পাতার কালো দাগ ক্ষয় কমানোর জন্য চুনের ব্যবহার হয়। বিভিন্ন কীটপতঙ্গ ও ছত্রাকের আক্রমণ রোধে সম্প্রতি টাইকোডার্মা ও সেক্স ফেরোমেনের মতো নব্য প্রযুক্তির ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে।
উৎপাদিত ভেষজের শুকনো ও প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরি করে বাজারজাতকরণ হয় শহরের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে, যেখানে প্রায় ১০০টি প্রতিষ্ঠান যুক্ত রয়েছে। এই পণ্যগুলোর মান উন্নয়নের জন্য অণুধান করা হয় গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে।
স্থানীয় কৃষক, সমবায় নেতা ও কবিরাজ মো. জয়নাল আবেদিন বলেন, অ্যালোভেরাকে দীর্ঘসময় সংরক্ষণ ও প্রসেসিং করার জন্য হিমাগার নির্মাণের পরিকল্পনা থাকা জরুরী। তিনি আরও বলেন, একটি প্রসাধনী কারখানা বা সাবানের কারখানা স্থাপন হলে এই উদ্যোগ আরও সফল হবে এবং কৃষকরা বেশি লাভবান হবেন।
খোলাবাড়িয়া হাজিগঞ্জ বাজারের ভেষজ উৎপাদন ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম জানান, গ্রামে একটি ঔষধি উদ্ভিদ গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয়েছে। এর ফলে আমাদের ভেষজ পণ্যদের মান নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে এবং প্রসাধনী ও ঔষধ উৎপাদনকারীর আগমন বাড়বে, যা এই ঔষধি পল্লীর উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রাখতে পারে।
নাটোর সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা নীলিমা জাহান বলেন, প্রায় ১০ হাজার মানুষ এই ভেষজ শিল্পে জড়িত, তারা উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। এর পাশাপাশি সংস্থার সম্প্রসারণের কাজও দ্রুত এগিয়ে চলছে।
অপর দিকে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নাটোর জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. হাবিবুল ইসলাম খান বলেন, যদি ভেষজ পল্লীতে আরও হিমাগার, গবেষণা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র স্থাপন করা যায়, তাহলে কৃষকগণ আরও লাভবান হবেন এবং দেশের এই একক ঔষধি পল্লী আরও সমৃদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত হবে।






