দেশের অর্থনীতির প্রতিরোধের মুখোমুখি তিনটি মূল চ্যালেঞ্জ রয়েছে—বিনিয়োগে ভাটা, ঋণের সংকোচন এবং উচ্চ সুদের হার। এই পরিস্থিতির কারণে দেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) মাসিক অর্থনৈতিক আপডেট প্রতিবেদনে এসব তথ্য বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যা সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতির প্রবণতা কিছুটা কমে এসেছে, পাশাপাশি সাধারণ আমানত প্রবৃদ্ধিও পুনরুদ্ধার হয়। এটি সরকারের এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপের ফল। খাদ্যসচিব, ই-মনির জন্য ই-অলস ব্যাংকিং, এবং সরকারের অর্থবন্টনের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে আমানত বাড়ানোর উদ্যোগগুলো এই উন্নতির অংশ। প্রবাসী আয়ের অর্থাৎ প্রবাসীদের অর্থের প্রবাহও এই প্রবণতাকে সমর্থন করেছে। এছাড়াও, ভবিষ্যৎ নির্বাচন কার্যক্রম দেশের অর্থনীতিতে সাময়িক গতি এনে বিনিয়োগকারীদের মনোভাবকে উন্নত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি সামান্য বেড়ে ৮.৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা আগস্টে ছিল ৮.২৯ শতাংশ। খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত খাতের দামেও এই ছোট পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। গত বছরের আগস্ট থেকে গড় মূল্যস্ফীতি স্থির ছিল ৯.৫৬ শতাংশ। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গতির উর্ধ্বগামিতার পেছনে তেলের দামের ৫০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধিই প্রধান কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
খাদ্য মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে চালের অবদান ফেব্রুয়ারি থেকে অপ্রতিরোধ্য ছিল, তবে আগস্টের ৪৮.৩৭ শতাংশ থেকে সেপ্টেম্বরে শুরু করে ৪৫ শতাংশে নেমে এসেছে। আলু এবং পেঁয়াজের দাম কমে সাধারণ ভোক্তাদের মধ্যে স্বস্তি বাড়িয়েছে। সেপ্টেম্বরে মোটা, মাঝারি, ও সরু চালের দাম প্রতি শতাংশে কমেছে।
সরকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য ৮ অক্টোবর ভারতের কাছ থেকে ৫০ হাজার টন চাল এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম আমদানি করতে অনুমোদন দেয়। আরও ৪ লাখ টন খাদ্যশস্য নভেম্বরে আসার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে। এই অর্থবছরে সরকারি খাদ্যশস্য বিতরণে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৪ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। বর্তমানে হাতে রয়েছে প্রায় ১৫ লাখ ৫ হাজার টন খাদ্যশস্যের মজুদ।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা মার্চে ২৫.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১.৪ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই রিজার্ভ ২০.৪ বিলিয়ন থেকে ২৬.৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
রপ্তানি আয় কিছুটা কমে সেপ্টেম্বরে ৩.৬৩ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়ায়, যা আগস্টে ছিল ৩.৯২ বিলিয়ন ও জুলাইয়ে ৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার। এর মূল কারণ হলো মৌসুমি প্রভাব এবং তৈরি পোশাক রপ্তানি কমে যাওয়া। তবে পাটজাত পণ্য, চামড়া, ও হালকা প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি এখনও স্থিতিশীল রয়েছে। ২০২৫ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বরে মোট রপ্তানি পূর্বের তুলনায় বেশি হওয়ার আশাঙ্কা করা হচ্ছে, যা ওই খাতের স্থিতিস্থাপকতা নির্দেশ করে।
টাকার বিনিময় হারও সামান্য স্থির রয়েছে, যেখানে প্রতি মার্কিন ডলারে বাংলাদেশি টাকা ১২১ থেকে ১২২ এর মধ্যে। একই সময়ে রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট (আরইইআর) সামান্য বেড়ে ১২১.২ থেকে ১২৭.২ হয়েছে, যা বাংলাদেশের উৎপাদনশীলতা ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বাড়ানোর সংকেত।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত ব্যাংকিং সেক্টরে মোট আমানত ১০.০১ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ব্রড মানি (এম২) ৭.৭৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। রাজস্ব আদায়ও গতিশীল, যেখানে জুলাই ও আগস্টে মোট ৫৪ হাজার ৪২২ কোটি টাকা রাজস্ব সংগৃহীত হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২১ শতাংশ বেশি। এই বৈষম্য ভ্যাটের প্রবৃদ্ধি (৩৩.৮%) ও আয়কর দ্বিগুণের বেশি (২৪%) বৃদ্ধি থেকেই স্পষ্ট।
অধিকতর দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়াতে, এনবিআর নতুন ১২টি কমিশনারেট ও কাস্টমস হাউস স্থাপন করেছে এবং ৩,৬০০ নতুন পদ সৃষ্টি করেছে, যার মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহ ও নজরদারি আরও শক্তিশালী হবে।






