দেশের তৈরি পোশাক খাতে সরকারের সর্বশেষ সংশোধিত ন্যূনতম মজুরি কাঠামো এখনো সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হয়ে উঠেনি। সম্প্রতি এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, শ্রমিকদের প্রায় ১৩ শতাংশ এখনো বর্ধিত মজুরি পুরোপুরি পাননি। কারো ক্ষেত্রে আংশিকভাবে বৃদ্ধিөгөн পর্যন্ত হয়েছে, আবার কেউ কেউ ঠিকভাবে মজুরি পাননি।
গবেষণাটি ২০২৫ সালের মে ও জুন মাসে পরিচালিত এক জরিপের ভিত্তিতে করা হয়েছে। দেশের প্রধান পোশাক উৎপাদনকারী এলাকা ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের মোট ৬০টি কারখানার ২৪০ জন শ্রমিকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
গত রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন: বাস্তব অবস্থা ও শ্রমিকদের ওপর প্রভাব’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আওয়াজ ফাউন্ডেশন, যেখানে মন্ডিয়াল এফএনভির সহায়তা নেওয়া হয়। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নাজমা আক্তার।
সরকার ২০২৩ সালে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের জন্য নতুন ন্যূনতম মাসিক মজুরি ১২,৫০০ টাকা নির্ধারণ করে, যা ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাথমিক সময়ে অনেক শ্রমিকই পুরোপুরি এই নতুন বেতন কাঠামো অনুসারে বেতন পাননি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, প্রায় ৮৭ শতাংশ শ্রমিক নতুন কাঠামো অনুযায়ী সম্পূর্ণ বর্ধিত মজুরি পাচ্ছেন। কিন্তু বাকি ১৩ শতাংশ শ্রমিকের মধ্যে ৮ শতাংশ আংশিকভাবে এবং প্রায় ৫ শতাংশ এখনো কোনভাবেই এই বেতন পেতে পারেননি। তিনি আরও যোগ করেন, জরিপে অন্তর্ভুক্ত কারখানাগুলোর মধ্যে নিট, ওভেন এবং কম্পোজিট ইউনিটগুলোকে দেখা হয়েছে, যা মোট খাতের বর্তমান পরিস্থিতির একটি চিত্র তুলে ধরে।
অনুষ্ঠানে সাবেক শ্রম সচিব এএইচএম শফিকুজ্জামান, শ্রম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবদুস সামাদ আল আজাদ এবং সলিডারিটি সেন্টার বাংলাদেশের কান্ট্রি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর এ কে এম নাসিমসহ অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, যেখানে শ্রমিক সংগঠন বা ইউনিয়ন আছে, সেখানে বর্ধিত মজুরি বাস্তবায়নের হার তুলনামূলকভাবে বেশি।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, নতুন মজুরি কাঠামো কার্যকরের পর ৩১ শতাংশ শ্রমিক অতিরিক্ত কাজের (ওভারটাইম) বেতন পেতে দেরি করেছেন—কাজের জন্য বেতন তাদের ১ থেকে ১০ মাস পর্যন্ত ফেরত পাওয়াই হয়ে থাকে। এছাড়া, ৫২ শতাংশ শ্রমিক কাজের চাপ ও উৎপাদন লক্ষ্য বৃদ্ধিকে মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ২২ শতাংশ চাকরির অনিশ্চয়তা, ১৪ শতাংশ অনিয়মিত বেতন এবং ১১ শতাংশ গ্রেড নির্ধারণ ও পদোন্নতিতে বিভ্রান্তির কথা জানিয়েছেন।
অংশগ্রহণকারী শ্রমিকদের মধ্যে ১৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা জানতেন না যে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে ৯ শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট। তবে অধিকাংশই বলছেন, তাদের জানানো হয়েছে এটি কার্যকর হয়েছে, কিন্তু ১৩ শতাংশ এখনও সেই ইনক্রিমেন্ট পাননি।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, গবেষণায় উল্লেখিত কারখানাগুলোর বেশিরভাগের তথ্য স্পষ্ট নয় যে তারা বিজিএমইএ বা বিকেএমইএ সদস্য কিনা। তাঁর মতে, রপ্তানিমুখী কারখানার শ্রমিকরা সাধারণত মাসে ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পেয়ে থাকেন। তিনি প্রস্তাব করেন, প্রতি পাঁচ বছরে নয়, বরং বছর বছর মজুরি পুনর্বিবেচনার ব্যবস্থা করলে শ্রমিক অন্দোলন ও উৎপাদনে বিঘ্ন কমবে।
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম উল্লেখ করেন, কোনো সদস্য কারখানা বর্ধিত মজুরি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়নি। কিছু কারখানা আংশিকভাবে মজুরি দিয়েছে; তবে যেসব কারখানা সদস্য নয়, তাদের তদারকি সরকারেরই করার দায়িত্ব বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বাংলাদেশ প্রোগ্রাম ম্যানেজার নীরান রামজুথন বলেন, শ্রমিকদের জন্য সময়মতো ও পর্যাপ্ত বেতন প্রদান তাঁদের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার না থাকলে শুধু শ্রমিক না, দেশের সুনামও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, অনিয়ম রোধে তদারকি বাড়াতে হবে, ফলাফল প্রকাশ করতে হবে এবং নিয়মিত মজুরি পুনর্বিবেচনা চালাতে হবে। পাশাপাশি ক্রেতাদেরও দায়িত্বশীল ক্রয়নীতি অনুসরণ করা জরুরি।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতার বলেন, গেজেটে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় অনেক মালিক নিজেদের ইচ্ছামতো গ্রেড নির্ধারণ করছেন, যার ফলে শ্রমিকরা বৈধ বেতন বৃদ্ধির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ছোট কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বড় কারখানাগুলো আরও বিস্তার লাভ করছে। এর ফলে, দেশের সার্বিক উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।






