নওগাঁয় সরকারি মৎস্য বীজ উৎপাদন খামার থেকে উন্নত মানের রেনু সরবরাহের ধারাবাহিক সফলতার ফলস্বরূপ, মাছ চাষিদের মধ্যে এই চাহিদা দিন দিন আরও বৃদ্ধির পথে। তবে এর পাশাপাশি চাহিদার তুলনায় উৎপাদন অতীতের মতোই কম থাকায় মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে মাছচাষিরা বেশি দামে বেসরকারি খামার থেকে রেনু কিনতে বাধ্য হচ্ছেন, যা তাদের খরচের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। উপকরণ ও জনবলের উন্নয়ন ঘটিয়ে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন আসলে তারা লাভবান হবেন এবং রাজস্বও বাড়বে।
নওগাঁ একটি কৃষিপ্রধান এবং সমৃদ্ধ জেলা হলেও মৎস্য খাতে তার এগিয়ে থাকার পরিচিতি রয়েছে। সরকারি খামার থেকে উন্নত মানের রেনু সরবরাহের কারণে মাছচাষের অভিজ্ঞতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিপেয়েছে। উন্নত মানের রেনু সরবরাহ নিশ্চিত হলে এটি দেশের সামগ্রিক মাছের উৎপাদনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি এটি প্রোটিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় দেখা যায়, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে রেনুর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২০০ কেজি, যা থেকে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ইতিমধ্যেই বিগত বছরগুলোতে এই রাজস্ব আয় সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৩৭ কেজি রেনু থেকে করের পরিমাণ ৭ লাখ ৯ হাজার টাকা এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১২২ কেজি রেনু থেকে আয় হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। ২০২২-২৩ সালে ১২০ কেজি রেনু থেকে আয় ছিল ৬ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টাকা, আর ২০২১-২২ সালে ৭৭ কেজি থেকে ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা রাজস্ব আসে।
সরকারি মৎস্য বীজ উৎপাদন খামারটি নওগাঁ শহরের আরজি-নওগাঁ অফিসরের ১১ একর জমিতে অবস্থিত। এখানে সাড়ে ৪ একর জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে ১০টি পুকুর, যেখানে কার্প জাতীয় মাছের মা-মাছ—রুই, মৃগেল, কাতলা, কালবাউস ও পাঙাশসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ চাষ করা হয়। এ স্থান থেকে বছরে পাঁচ মাসের জন্য উন্নত মানের রেনু উৎপাদন করা হয়, তবে চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল হওয়ায় মাছচাষিরা অনেকটাই নির্ভরশীল বেসরকারি খামার থেকে। জেলা জুড়ে মোট ৩১টি বেসরকারি মৎস্য বীজ উৎপাদন খামার রয়েছে, যা বছর বছর প্রায় ১৩ মেট্রিক টন কার্প জাতীয় রেনু উৎপাদন করে। এই রেনু সরবরাহ হয় জেলার বাইরে পাশের জেলাগুলোর জন্য।
মৎস্য বীজ উৎপাদন খামারগুলো মাছ চাষ, সরবরাহ এবং সাধারণ মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। উন্নত মানের পোনা সরবরাহের মাধ্যমে তারা মাছের উৎপাদন বাড়িয়ে তুলছেন, আর এতে মাছচাষিরা উপকৃত হচ্ছেন। তবে তারা মনে করেন যে সরকারি খামার থেকে রেনুর মান ও পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করা উচিত, যাতে করে চাষিরা আরও লাভবান হতে পারেন।
অঞ্চলীয় মাছচাষিরা জানান, সরকারি খামারের রেনু মূল্য তুলনামূলকভাবে কম এবং মানও ভালো। কিন্তু রেনুর চাহিদা পূরণে এই খামার যথেষ্ট নয়, ফলে চাষিরা অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে বেসরকারি খামার থেকে বিভিন্ন রকমের রেনু ক্রয় করেন। বিশেষ করে প্রতি কেজিতে ৫০০ থেকে ৯০০ টাকা দাম বেশি দিতে হয়, তবে মানের দিক দিয়ে সরকারি রেনু বেশ ভালো বলে তারা জানিয়েছেন। লাভের মুখ দেখছেন এই মাছচাষিরা।
সদর উপজেলার চকআবরশ গ্রামের মাছচাষি মীর বকস বলেন, ‘সরকারি খামারের রেনু উন্নত মানের, এ রেনু থেকে মাছের স্বাস্থ্য ও বৃদ্ধি ভালো হয়। এতে বাজারে দামও ভালো পাওয়া যায় এবং লাভের সুযোগ বেশি।’
হ্যাচারি টেকনিশিয়ান ইমরান হোসেন বলেন, ‘এখানে খামার পরিচালকের সঙ্গে মোট পাঁচজন জনবল কাজ করছেন। জনবল কম থাকায় উৎপাদন বাধা পায়। জনবল ও উপকরণ বাড়ালে আরও বেশি রেনু উৎপাদন সম্ভব হবে, ফলে রাজস্ব আয়ও বাড়বে।’
মৎস্য খামার ব্যবস্থাপক কৃষিবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য মানসম্পন্ন রেনে উৎপাদন ও সরবরাহ। পাশাপাশি চাষিদের উদ্বুদ্ধ করা, প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং পুকুরের সঠিক পরিদর্শন করা হয়। ভবিষ্যতে নতুন জাতের রেনু গবেষণা করলেই আরও বেশি উপকার হবে আপাতত।’
তিনি আরও বলেন, ‘জেলায় বেশ কিছু বেসরকারি মাছের খামার গড়ে উঠেছে, যা আমাদের বিভাগ থেকে পর্যবেক্ষণ ও তদারকি করা হচ্ছে। সরকারি এবং বেসরকারি হ্যাচারির সমন্বয়ে মাছের সম্পদ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।’
মৎস কর্মকর্তা মো. ফেরদৌস আলী বলেন, ‘ভালো মানের মা-মাছ থেকে উৎপাদিত রেনু মানও উন্নত হয়। পদ্মা, যমুনা ও অন্যান্য নদী থেকে উচ্চ মানের মা-মাছ সংগ্রহ করে রেনু উৎপাদন চালানো হয়। সরকারি খামার মাছচাষিদের রেনু সংগ্রহে উৎসাহিত করছে, এতে তারা লাভে থাকেন ও উপকৃত হন।’






