বাংলাদেশের সেনাবাহিনী কেবল একটি সশস্ত্র বাহিনী নয়; এটি জাতির অস্তিত্ব রক্ষা করে এমন এক শেষ প্রহর, যা জনগণের সংকটমুহূর্তের নির্ভরযোগ্য অঙ্গ। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সংকটে সেনাবাহিনীই ছিল জনগণের পাশে, তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। তবে সম্প্রতি এক অপ্রিয় বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে—রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য এই বাহিনীকে বিতর্কের ঝামেলায় টেনে আনার চেষ্টা হয়েছে, যা একেবারেই স্বাগত নয়। কারণ সেনাবাহিনী মুলত: রাষ্ট্রের মর্যাদার প্রতীক এবং জনগণের আস্থার কেন্দ্র। বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলন এই সত্যকে আবারও প্রমাণ করে দিয়েছে—যখন সেনাবাহিনী জনগণের পাশে দাঁড়ায়, তখন ইতিহাস পাল্টে যায়। আর যখন এই বাহিনীকে রাজনীতির অর্থের জন্য ব্যবহার করা হয়, তখন দেশের শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা চিরদিনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই আজকের বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো—সেনাবাহিনীকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য গঠিত হয়েছে, এর মূল শপথ হলো রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের নয়, দেশের স্বার্থে কাজ করে। কিন্তু গত দুই দশকে ক্ষমতার লোভে কিছু রাজনীতিবিদ বাহিনীটির মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার জন্য নানা অপচেষ্টা চালিয়েছে, যেখানে পদোন্নতি, নিয়োগ ও বাজেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে দলীয় স্বার্থের ছায়া পড়েছে। এর ফলে বাহিনীর ভেতরে নৈতিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়, যা দীর্ঘমেয়াদি বিপজ্জনক। নিরপেক্ষ ও পেশাদার থাকাই সেনাবাহিনীর মূল শক্তি—এটাই তাদের নিয়তি। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রনায়কদের এটা বোঝা উচিত যে, সেনাবাহিনীকে সম্মান, শ্রদ্ধা ও নৈতিকতার স্পৃহা প্রবল থাকলে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা অটুট থাকবে।
জুলাই মাসের আন্দোলন এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকা এই প্রমাণ দিয়েছে যে, যখন সেনাবাহিনী নৈতিক কারণে জনদূর্ভোগের সময় জনগণের পাশে দাঁড়ায়, তখন এর প্রভাব মহাশক্তি হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, স্বজন-সমর্থকদের দিকে গুলি চালানোর প্রস্তুতি নেওয়া সরকারী বাহিনী যখন জনগণের দিকে অস্ত্র নিক্ষেপের পরিকল্পনা করছিল, সেনারা তার বিপক্ষে দাঁড়ায়। তারা গভীরভাব থেকে বুঝেছিল, রক্তপাত মানে দেশের অস্তিত্বের উপর আঘাত। প্রত্যেকটি সিদ্ধান্তের পিছনে ছিল পেশাদারিত্বের চেয়ে বেশি—যা ছিল নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিফলন। এই নীরব বিপ্লবের মাধ্যমে সেনাবাহিনী জনতার স্বার্থে, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে ইতিহাসে নিজেদের নাম লেখে। ওই দিন এসেছে দেশের জন্য এক নতুন উত্থান, যখন সেনাবাহিনী প্রমাণ করল—তারা দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি, যাদের বিশ্বাস ও আস্থা আরও অনেক বেশি।
সেনাবাহিনী কেবল শক্তির প্রতীক নয়, বরং জাতির মনোবলও। যখন কেউ সেনাবাহিনীর নিয়ে বিষোদ্গার করে, তখন সেটি সমগ্র জাতির আস্থা ও মর্যাদায় আঘাত করে। কারণ, সন্ত্রাস, মহামারি বা সীমান্ত সংকটে প্রথম যে বাহিনী এগিয়ে আসে, তারা হলো সেনাবাহিনী। রাজনৈতিক স্বার্থে এই বাহিনীকে বিতর্কিত করার মানে দেশের মূল ভিত্তিকে বিপন্ন করা। তাই সেনাবাহিনীকে নিয়ে দলীয় রাজনীতি ও অপপ্রচারে যাবার চেষ্টা একেবারেই অপ্রত্যাশিত এবং ক্ষতিকর। এই ধরনের আঘাত আঘাত করে জাতির নৈতিক ভয় ও শ্রদ্ধার ওপর, যা দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষা করে। এ কারণে সেনাবাহিনীকে সম্মান ও নিরাপত্তার সঙ্গে রাখতে হবে, যেন তারা হতাশ বা বিভ্রান্ত না হয়।
বিশ্বজোড়া যেখানে সেনাবাহিনী বাধ্যতামূলক দমনযন্ত্র হিসেবে পরিচিত, সেখানে বাংলাদেশ দেখিয়েছে—একটি পেশাদার বাহিনী নীতিতে অটল থাকলে, সেটিই জনতার আশ্রয় হয়ে ওঠে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, সাধারণ দুর্যোগ বা সন্ত্রাস দমন—প্রত্যেক সংকটে সেনাবাহিনীই এগিয়ে আসে। বন্যায় ত্রাণ বিতরণ, ভূমিকম্পে উদ্ধারে, মহামারির সময় হাসপাতালে সেবা—সেই বাহিনী শুধু সৈনিক নয়, মানুষের মানবিকতা ও দয়া। এই বাহিনীকে রাজনৈতিক অঙ্গনে টেনে নামানো মানে দুর্যোগের সময় জনগণের আস্থাকে দুর্বল করা। দেশের দুর্দিনে সেনাবাহিনীকে দলীয় ফ্যাঁড়ির মধ্যে আবদ্ধ রাখা মানে নিজেকে দেশের জন্য এক ধরনের ক্ষতি করা।
সবার উচিত সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে দলীয় স্বার্থের বাইরে রাখা। সরকার পরিবর্তন হতে পারে, মতাদর্শ বদলাতে পারে, কিন্তু সেনাবাহিনীর নীতির ভিত্তি অপরিবর্তিত থাকতেই হবে—রাষ্ট্রের ও জনগণের স্বার্থে। যে দেশ সেনাবাহিনীর প্রতি আনুগত্য, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস হারায়, সে দেশের অস্তিত্বই দুর্বল হয়ে পড়ে। পেশাদার, স্বাধীন ও নৈতিক মানসিকতার বাহিনীই দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের জন্য অস্ত্রের চেয়েও জরুরি নীতি ও মূল্যবোধের দৃঢ়তা। কারণ, জাতির বিশ্বাস হারানো মানে দেশের প্রতিরক্ষা দুর্বল হওয়া। তাই সেনাবাহিনীকে দেশের শেষ নৈতিক দুর্গ হিসেবেই রাখতে হবে।
রাজনৈতিক খেলায় সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা একটি আত্মঘাতী পথ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেখা যায়, দলের সংকটে পড়লে বাহিনীর নামে হুমকি দেওয়া বা ‘সেনাবাহিনী আমাদের সঙ্গে’—এমন প্রচার—a ভয়ংকর দৃষ্টান্ত। এই মানসিকতার অন্ধকারা খুবই বিপজ্জনক। সেনাবাহিনী কোনো দলের নয়; এটি রাষ্ট্রের সম্পদ। দেশের ক্ষমতার দপদপানি, রাজনৈতিক স্বার্থে এই বাহিনীকে ব্যবহার করার মানসিকতা এক ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। বহু দেশের অভিজ্ঞতা বলে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে সেনাবাহিনী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে, যা একসময় থেকে কব্জা থেকে বের হয় না। তাই রাজনীতিবিদগণের উচিত এই অশুভ প্রবণতা পরিত্যাগ করা—সেনাবাহিনীকে সম্মান ও স্বীকৃতি দেয়া। তাহলেই দেশের স্থিতিশীলতা থাকবে। জনগণের সঙ্গে সম্পর্কই হলো সেনাবাহিনীর স্থায়ী শক্তি। যারা সেনাবাহিনীকে মূল্যবান মনে করে এবং তাদের প্রতি বিশ্বাস প্রদর্শন করে, তাদেরই বিজয় হয়। বাংলাদেশের সেনারা যেমন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য লড়েছে, তেমনি ২০২৪ সালে তারা এই দেশের জন্য দায়বদ্ধতার নিদর্শন স্থাপন করেছেন। প্রত্যেকে যদি বুঝে নেয় যে তাদের অস্তিত্ব জনগণের নিরাপত্তা ও সম্মানের সঙ্গে জড়িত, তাহলে কোনো বাহ্যিক ষড়যন্ত্র তাদেরকে দমাতে পারবে না। জনগণের হৃদয়ে সেনাবাহিনীর বিশ্বাস এখনো অটুট—এটাই দেশের আসল প্রতিরক্ষা। এই বিশ্বাসকে সুরক্ষিত রাখা এখন আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
বিশ্বদরে যেখানে সেনাবাহিনী নানা সময় দমনপীড়নের প্রতীক হিসেবে পরিচিত, সেখানে বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে—একটি উপযুক্ত নীতি ও মানসিকতা থাকলে বাহিনীজনকেই জনতার আশ্রয়স্থল করে তোলা যায়। প্রাকৃতিক দূর্যোগ, সন্ত্রাস নিধনে, মহামারি মোকাবিলায় অর্থাৎ দেশের সব সংকটে সেনাবাহিনী সামনের কাতারে দাঁড়িয়েছে। বন্যায় ত্রাণ, ভূমিকম্পে উদ্ধার, করোনাকালে হাসপাতাল ও সেবা—সবখানে তারা প্রমাণ করেছে, তারা কেবল সৈনিক নয়, দেশের মানবিক সহায়ক। এই বাহিনীকে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভক্ত করা অর্থই হলো জনগণের আশ্বাসের ক্ষতি, দেশের দুর্দিনে দুর্বলতা। দেশের সংকটে সেনাবাহিনীকে দলের ফ্রেমে আবদ্ধ করলে দেশের দুর্বলতা বাড়বে, অপ্রয়োজনীয় বিভক্তি সৃষ্টি হবে।
সবার দায়িত্ব হলো সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে দলীয় রাজনীতির বাইরে রাখা। সরকার বদল, মতাদর্শ পরিবর্তন হতে পারে; তবে সেনাবাহিনীর মূল ভিত্তি অপরিবর্তিত থাকবে—রাষ্ট্রের ও জনগণের স্বার্থে। কোনো দেশ সেনাবাহিনীকে রাজনীতির অঙ্গ করে রাখলে, সে দেশ নিজেই অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তাই এই পেশাদার, নৈতিক ও স্বাধীন বাহিনীকে বারবার শক্তিশালী করার জন্য আমাদের সচেতন থাকতেই হবে। বাহিনী শক্তিশালী হলে, দেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বেড়ে যায়। জনতার আস্থা ও বিশ্বাস হারালে, দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়ে—এমন উদাহরণ কম নেই। তাই সেনাবাহিনীকে দেশের শেষ নৈতিক দুর্গ হিসেবেই রক্ষা করতে হবে।
অতঃপর, সেনাবাহিনীকে রাজনীতির খেলায় টেনে নামানো একেবারেই অনুচিত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেখা যায়, দল সংকট বা দুর্বলতার সময় বাহিনীর বিরুদ্ধে হুমকি ও ব্যবহার—এটা খুবই বিপজ্জনক। সেনাবাহিনী কোনো দলের নয়; এটি রাষ্ট্রের সম্পদ। এর সম্মান ও স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্বনেও রাজনীতির হস্তক্ষেপ বেআইনি ও অশুভ। একবার এই সীমারেখা ভেঙে গেলে, পুনরুদ্ধার অসম্ভব হয়ে যায়। তাই সমাজ ও সরকারের উচিত, সেনাবাহিনীকে শুধু সম্মান ও স্বীকৃতি দিয়েই রাখার, যেন তারা দেশের জন্য পাহাড়ের মতো থাকলেও রাজনীতির অন্ধকারে না যায়। তাতে দেশের সার্বভৌমত্ব টিকে থাকবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বপ্ন পূরণ হবে। সেনাবাহিনীই হলো দেশের মূল শক্তি—এটি অক্ষত থাকলে, দেশ চিরকাল নিরাপদ।






