বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু ইতিবাকর ফলাফলের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে দেশের ডলার রিজার্ভের পুনরুদ্ধার এবং রেমিট্যান্স প্রবাহে অপ্রত্যাশিত বৃদ্ধি এই শক্তিশালী অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার আভাস দিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকারী ও অর্থনীতিবিদরা মনে করছে, এই উন্নতি দেশীয় অর্থনীতি স্থিতিশীল করতে এবং ভবিষ্যতের জন্য বিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি করতে অনেকটাই সহায়ক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩২.১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। তবে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে, অর্থনীতির সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিবেচনায়, এই রিজার্ভের পরিমাণ ২৭.৩৫ বিলিয়ন ডলার। এই রিজার্ভের মাধ্যমে দেশের প্রায় সাড়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় সহজেই মেটানো সম্ভব, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অন্যতম সূচক হিসেবে বিবেচিত। যদিও আদর্শ রিজার্ভের পরিমাণ অন্তত ছয় মাসের আমদানি সক্ষমতা থাকা উচিত, কিন্তু বর্তমানে এই পরিস্থিতি অনেকটাই স্বস্তিদায়ক বলে ধারণা করছেন অর্থনীতির সাথে যুক্ত বিশেষজ্ঞরা।
অবশ্যই, এই অর্থনৈতিক ইতিবাচক পরিবর্তনের মূল চাবিকাঠি হলো রেমিট্যান্স প্রবাহের অভূতপূর্ব বৃদ্ধি। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের পর থেকে এই প্রবাহের উল্লম্ফন লক্ষ্য করা গেছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও, দেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে—এটি ২০২০-২১ অর্থবছরের রেকর্ড ২৪.৭৭ ডলার থেকে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন। আর এই ধারা চলমান থাকায়, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রেমিট্যান্স এসেছে ৭.৫৯ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছর একই সময়ে তুলনায় ১৬.২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মত ব্যক্ত করছেন, এই রেমিট্যান্সের ধারা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল ও শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এর ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেমন বাড়ছে, একই সাথে টাকার বিনিময় হারও স্থিতিশীল হয়েছে, যা দামুড়ি ও বিনিয়োগের জন্য সুবর্গ বলে মনে করছেন।
আইএমএফের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের উপপরিচালক থমাস হেলব্লিং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ বৃদ্ধিকে স্বাগত জানান, তিনি বলেন, “দেশের বাজেট ও লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা হওয়ায় রিজার্ভের বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ, যা আইএমএফ-সহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থার লক্ষ্য।”
অন্যদিকে, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তারেন্দু বলেন, “বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার হচ্ছে, যদিও এটি এখনো পুরোপুরি শক্তিশালী হয়নি। তবে রিজার্ভের অবস্থা এখন বেশ স্বাচ্ছন্দ্যদায়ক, যা দেশের অর্থনীতির ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করছে।”
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনও বলে থাকেন, “রেমিট্যান্সের বৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বাভাবিকতা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। ব্যাংকিং সেক্টরে ডলার সংকট কিছুটা লাঘব হয়েছে, এবং বৈদেশিক লেনদেন সহজতর হচ্ছে।”
সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা নীতি ও বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের স্থিতিশীলতা এখন এই উন্নয়নের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। প্রবাসীদের ব্যাংক চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করতে সরকার ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। পাশাপাশি, হুন্ডি ও হাওলা চ্যানেলে অবৈধ লেনদেন কমাতে সরকারের কঠোর অভিযান চলছে, যার ফলে বৈধ পথে রেমিট্যান্সের প্রবাহ শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
বেশ কিছু ব্যাংকের জরিপে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, প্রবাসী পরিবারগুলো এখন অপ্রতুল ধরণের বাংলাদেশি টাকা স্বস্তির সাথে ব্যবহার করছে। ডাচ-বাংলা ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শহিদ উল্লাহ বলেন, “রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর থেকে হুন্ডি ও হাওলার বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালানো হয়েছে। এর ফলে অবৈধ লেনদেন অনেকটাই কমে এসেছে, এবং রেমিট্যান্সের সার্বিক প্রবাহে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।”
প্রিমিয়ার ব্যাংকের ডিএমডি আব্দুল কায়উম চৌধুরী এই মত প্রকাশ করে বলেন, “২০২৪ সালের আগস্ট থেকে রেমিট্যান্স ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অবনতি আটকাতে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।” এই সব উন্নতি দেশের জন্য একান্তই স্বস্তিদায়ক, যা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে আরো বিশ্বাসের সাথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম।






