দেশের কৃষিকে দীর্ঘমেয়াদে আধুনিক ও টেকসই রূপ দেওয়ার জন্য সরকার একটি ২৫ বছর মেয়াদী মহাপরিকল্পনা গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সব ধরনের ঝুঁকি, প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে একটি সমন্বিত কাঠামো তৈরি চালু করা হচ্ছে, যার চূড়ান্ত খসড়া ডিসেম্বরের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে যাবে।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রথম দিনে ‘কৃষি ও খাদ্যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার’ শীর্ষক এই অঙ্গীকারনামার ব্যাপারে তথ্য জানান কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরাম (বিএজেএফ) এর আয়োজনে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথম দিনের আলোচনার বিষয় ছিল ‘কৃষির রূপান্তর: দেশীয় উপযুক্ত কৃষিযন্ত্র ও কৃষিপণ্য রপ্তানির চ্যালেঞ্জ’।
সচিব জানান, ১৩টি মূল খাত এবং এর অধীন অসংখ্য উপখাতকে কেন্দ্র করে এই পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে। এর পাশাপাশি, কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৭টি সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জন্যও ২৫ বছর ব্যাপী আলাদা রোডম্যাপ প্রস্তুত করা হচ্ছে। এর সঙ্গে স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনাও রয়েছে, যা পাঁচ বছর অন্তর নতুন প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়িত হবে। তবে প্রতিটি প্রকল্পের জন্য ব্যাপক গবেষণা ও যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সার ব্যবস্থাপনা নিয়ে কৃষি সচিব বলেন, ‘আমরা এমন নীতি প্রণয়ন করছি, যাতে প্রতি বছর দুই-তিন হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হয়। চলতি বছরে এই সাশ্রয় হয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। এছাড়া, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের ৬০০ কোটি টাকা ফেরত গেছে সরকারের কোষাগারে। এর মাধ্যমে পুরো প্রকল্পটি সফলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘সবজি কেজি প্রতি ১০০ টাকায় বিক্রি হলে কেউ সমালোচনা করেন না, কিন্তু পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকা হলে হৈচৈ পড়ে যায়। ফলে, কৃষকদের ন্যায্য দাম পাওয়াই গুরুত্বপূর্ণ। আগামী তিন বছরের মধ্যে আদা ও পেঁয়াজের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্য রয়েছে, একই সঙ্গে আলুর দাম না পেয়ে কৃষকের আত্নহত্যার ঘটনা নিয়ে তিনি গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন।’
সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) যান্ত্রিক ধান চাষাবাদ প্রকল্পের পরিচালক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, দেশে কৃষিযন্ত্রের আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে স্থানীয় প্রযুক্তিতে কৃষিযন্ত্র তৈরির জন্য একটি সম্পূর্ণ ইকোসিস্টেম গড়ে উঠছে। এই উদ্যোগে শ্রীলঙ্কা ও জাপানের মতো দেশগুলোর প্রযুক্তিগত সহায়তা নেওয়া হচ্ছে, যার ফলে দেশীয় মানসম্পন্ন কৃষিযন্ত্রের উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। এটি সময়, শ্রম ও ব্যয় সাশ্রয় করতে সহায়ক হবে।
তিনি জানান, মাঠ পর্যায়ে উদ্যোক্তা সৃষ্টি, মেকানিক প্রশিক্ষণ, সার্ভিস হাব ও খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহের জন্য একটি সমন্বিত কাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে।
তবে দেশের আধুনিক কৃষিযন্ত্রের উৎপাদনে বেশ কিছু বড় বাধার মুখে পড়ছে বলে জানিয়েছেন ব্রির বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা দুরুল হুদা। তিনি বলেছিলেন, হালকা প্রকৌশল খাতে দক্ষতা ও প্রযুক্তির অভাব, সিএনসি ভিত্তিক প্রযুক্তির কম দেখা যান, এবং দক্ষ জনবল সংকটের কারণে অনেক উদ্যোক্তা আন্তর্জাতিক মানের কম্বাইন হারভেস্টার বা রাইস ট্রান্সপ্লানটার তৈরি করতে পারছেন না। তিনি দুঃখ করে বলেন, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও দেশে ইঞ্জিন তৈরির কোনও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে উঠতে পারেনি। পুরনো শিল্পগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিল্পভিত্তিও দুর্বল হয়ে পড়েছে।
কৃষিকে লাভজনক পেশায় রূপান্তর করার বিষয়ে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদের বলেন, ‘শুধু উৎপাদনই নয়, কৃষিকে একটি লাভজনক, সম্মানজনক ও শিক্ষিত পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এতে মানুষ কৃষিকে আরেকটি গুরুত্বসহকারে দেখবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পিকেএসএফের সহায়তায় মাঠে বছরে এক লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করা হয়, এর মধ্যে ৪০ শতাংশ কৃষি খাতে বিনিয়োগ হয়। দেশের কৃষি ঋণের প্রায় ৮৫ শতাংশ এফএমআই-এর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।’
উন্নত জাতের ধান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে ধান উৎপাদনে বিপ্লবের কথাও জানান ব্রি মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক শ্রম ও উন্নত জাতের ধান চাষের মাধ্যমে উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে। এখন প্রতি হেক্টর থেকে দেড় থেকে দুই টনের উৎপাদন হতো। তবে এখন অতিরিক্ত উন্নত জাত ও প্রযুক্তি ব্যবহারে গড়ে ফলন আরও বেশি হবে, ভবিষ্যতে প্রত্যাশা করা যায় ১০ টনের বেশি ফলন হবে।’
অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের চাহিদার উল্লেখ করে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘বিশ্বে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ বাজারের আকার চার ট্রিলিয়ন ডলার, যেখানে আমাদের দেশে কেবল এক বিলিয়ন ডলার। আমাদের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে বোঝার জন্য। তবে, এই খাতে বৈচিত্র্য ও মানের উন্নতি দরকার। এখনো ৪০০টির মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাও সবাই উন্নত মানের পণ্য উৎপাদন করতে পারছে না।’ তিনি বলেন, ‘কৃষি পণ্য রপ্তানির জন্য ১৮টি দপ্তর থেকে অনুমতি নিতে হয়, যা সময় ও খরচ বৃদ্ধি করে। এজন্য একদফা সার্ভিস কাঠামো চালু করতে হবে আর ব্র্যান্ডিং শক্তিশালী করতে হবে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পণ্য পরিচিতির জন্য দূতাবাসের সঙ্গে কাজ করতে হবে।’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘কৃষি পণ্য রপ্তানিতে মানদণ্ড মানতে অনেক সমস্যা হয়। আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার ও পর্যাপ্ত মান নিয়ন্ত্রণের অভাব রয়েছে। অনেক পণ্য ভারত ও সিঙ্গাপুরের পরীক্ষাগার থেকে পরীক্ষা করিয়ে আনতে হয়। বিএসটিআই এর মান বিশ্বের অনেক দেশে স্বীকৃত নয়। ফলে মানের উন্নয়নে আরও কঠোর হতে হবে এবং গ্রাম পর্যায় থেকেই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের কাজ শুরু করতে হবে।’






