আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি দেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি হবে গণভোট, যা জুলাইয়ের সনদ বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পিত। এই দিন সকাল সাড়ে সাতটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত টানা ভোট গ্রহণ চলবে। বুধবার (১১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন এই তফসিল ঘোষণা করেন। তার ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার ও বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়।
ভাষণের শুরুতেই মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে সিইসি তাদের আত্মার শান্তি কামনা করেন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থানে যারা আহত হয়েছেন বা নির্যাতিত হয়েছেন, তাদের প্রতি আমি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি। আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করে তিনি বলেন, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য আমাদের ভালোবাসা ও আত্মত্যাগ আমাদের মূল শক্তি। সংবিধান রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানার নিশ্চয়তা দেয়, এবং এই মালিকানাকে নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন অপরিহার্য। দুঃখের বিষয়, মানসম্পন্ন নির্বাচন না হওয়ায় আমাদের আজ বহু প্রত্যাশা অধরা থেকে যায়। এই প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়, যা আমাদের অঙ্গীকার করে একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন পরিচালনা করার।
প্রকাশিত তফসিলে বলা হয়, নির্বাচনে প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ২৯ ডিসেম্বর। মনোনয়নপত্রের বাছাই হবে ৩০ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারি। এরপর ১১ জানুয়ারি আপিলের জন্য সময় নির্ধারিত এবং ১২ থেকে ১৮ জানুয়ারি আপিল নিষ্পত্তির ব্যবস্থাকরা হবে। প্রার্থীতার শেষ সময় ২০ জানুয়ারি, এরপর ২১ জানুয়ারি চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ও প্রতীক বরাদ্দ হবে। নির্বাচনী প্রচার ২২ জানুয়ারি শুরু হয়ে ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে সাতটায় শেষ হবে। ১২ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে ৩০০ সংসদীয় আসনে ভোট গ্রহণ হবে।
এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি ৭৬ লাখের বেশি। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। এরই মধ্যে তিন লাখের বেশি প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়। এই সরকার দেড় বছর ধরে দায়িত্ব পালন করার পর, এখনই তফসিল ঘোষণা করল নির্বাচন কমিশন।
প্রথমে, গত বছর ডিসেম্বরে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার দাবিতে বিভিন্ন দল আন্দোলন করে। এরপর দল মতের মধ্যে আলোচনা ও বৈঠকে দিন নির্ধারিত হয়, যেখানে ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে, বিএনপি ও অন্য কিছু দল একমত হয়েছিল ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে। এই পরিস্থিতিতে, ইসি প্রস্তুতি হিসেবে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনকেই পরিকল্পনা করে।
গত ১৩ নভেম্বর, প্রধান উপদেষ্টার মাধ্যমে ঘোষণা আসে যে, জুলাইয়ে সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণভোট ও সংসদ নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। আজ, সিইসি এই দুই অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ নিশ্চিত করেছেন।
নির্বাচনে কেবল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোই দলীয় প্রতীকে অংশ নিতে পারবেন। বর্তমানে নিবন্ধিত দল সংখ্যা ৫৬, যাদের মধ্যে কিছু দল আইনি কারণে নিষিদ্ধ। আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত থাকায় তারা এই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। এরপর, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও কোন ব্যক্তি নির্বাচন করতে পারবেন।
বর্তমানে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, ২১ নভেম্বর নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন হয়। এই প্রথমবারের মতো, এই নতুন কমিশনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, একই দিনে ভোট ও গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়া। ইসি এর জন্য সময় ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, কারণ এ জন্য ভোটের সময় এক ঘণ্টা বৃদ্ধি ও ভোটকেন্দ্রে গোপন কক্ষের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
নির্বাচনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করতে সরকার সর্তক করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ দেশাত্মবোধক বাহিনী মোতায়েনের পাশাপাশি, এর জন্য প্রায় ৯ লাখ সেনা, পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। ইতোমধ্যে, নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে দেড় লাখেরও বেশি পুলিশ সদস্যকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিচালনা করতে এই রেকর্ড সংখ্যক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে।






