নদীবেষ্টিত দক্ষিণাঞ্চলের জনপদ হিসেবে বিখ্যাত বরিশাল বিভাগে আগে নৌযোগাযোগ ছিল গুরুত্বপূর্ণ ও সুদৃঢ়। মানুষ অচেনা বা ব্যয়বহুল রোড পরিবহনের পরিবর্তে সহজ, স্বল্প খরচে ও আরামদায়ক এই নৌপথগুলো ব্যবহার করে আসছিল। তবে অপূরণীয় ডুবোচর সৃষ্টি, নদীর নাব্য সংকট এবং অপরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ নৌ পথগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে অন্তত ১৫টি অভ্যন্তরীণ রুটে লঞ্চ চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে, আর যেগুলো এখনো সচল রয়েছে, সেগুলির চলাচল খুবই ঝুকিপূর্ণ। যাত্রী সংকট এবং অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যয়ের কারণে অন্য রুটগুলোও ভবিষ্যতে বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ব্রহ্মাণ্ডে নদীবেষ্টিত এই অঞ্চলের বাসিন্দারা বলছেন, এক দশক আগে বরিশাল থেকে বরগুনা, চরদোয়ানী, মহিপুর, পটুয়াখালী, কালাইয়া, লালমোহন, বাহেরচর, বোরহানউদ্দিন, ভাষানচর-হিজলা, মুলাদীসহ বহু নৌপথে শতাধিক লঞ্চ নিয়মিত চলাচল করত। তবে এখন মাত্র চারটি রুট সচল রয়েছে, তাও ঝুঁকির মধ্যে। বর্তমানে বরিশাল-ভোলা, মজুচৌধুরীর হাট এবং লক্ষ্মীপুর রুটে মাত্র ছয়টি লঞ্চ চলাচল করছে, যেগুলোরও নাব্য সংকটের কারণে যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শীতের মৌসুম এলেই মেঘনা, কীর্তনখোলা ও তেঁতুলিয়া নদীতে অসংখ্য ডুবোচর সৃষ্টি হয়, যা চলতি মৌসুমে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে কাটাখালি থেকে রহমতখালি পর্যন্ত নাব্য সংকট চরমে পৌঁছেছে, ফলে মাঝ নদীতে লঞ্চ আটকে যাত্রীরা বড় ভোগান্তিতে পড়ছেন।
লঞ্চ শ্রমিকরা জানিয়েছেন, প্রায়ই ২ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় অতিরিক্ত ঘুরে বিকল্প পথ ব্যবহার করতে হয়, যার ফলে যাত্রীরা সময়ের অপ্রাপ্যতা এবং অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছেন। এই সব কারণে অবস্থা এতটাই জটিল যে অনেক মালিক লঞ্চ বিক্রি করে দিচ্ছেন বা বন্ধ করে দিচ্ছেন। নদীপথ বন্ধ হওয়ায় যাত্রীরাও ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
নৌপথ সচল রাখতে নিয়মিত ড্রেজিংয়ের দাবি থাকলেও, অভিযোগ রয়েছে যে, ড্রেজিং কার্যক্রম অপরিকল্পিত ও খণ্ড খণ্ডভাবে হয়। এর ফলে প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল সংস্থার বরিশাল শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট ওয়াহিদুজ্জামান বলছেন, ‘প্রতি বছর ড্রেজিং হয়, কিন্তু যেখানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেখানে কাজ সম্ভব হচ্ছে না। পলি জমে আবারও নৌপথ বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকলে অভ্যন্তরীণ নৌযোগাযোগ পুরোপুরিই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’
বিআইডব্লিউটিএ এর তথ্যমতে, বরিশাল অঞ্চলের একতলা লঞ্চঘাট, বুখাইনগর নালা, নদীবন্দর ও হিজলার মৌলভীরহাট চ্যানেলসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নৌ পথের ড্রেজিং অব্যাহত রয়েছে। অন্য দিকে, মেহেন্দিগঞ্জের পাথরহাটের পুরোনো স্টিমার ঘাট, মূলাদীর নয়াভাঙ্গলী নদী, ভোলার চরফ্যাশনের কচ্ছপিয়া খাল ও বরিশাল নগরীর কীর্তনখোলার অঞ্চলেও ড্রেজিং শেষের পথে।
লঞ্চ মাস্টাররা জানাচ্ছেন, নাব্য সংকটের কারণে এই বছর বাহেরচর ও ভাসানচর রুট বন্ধ হয়ে গেছে। একই কারণে কয়েক বছর আগে বরিশাল থেকে গলাচিপা, বরগুনা, পাথরঘাটা, কালাইয়া, চরকলমি, ঘোষেরহাট, কালীগঞ্জ, চরদোয়ানী ও তুষখালী রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে বরিশাল থেকে ভোলা, পাথারহাট, লাহারহাট, লক্ষ্মীপুর ও মেহেন্দিগঞ্জসহ কিছু রুটে ছোট লঞ্চ চলাচল করছে, তবে নাব্য সংকট তীব্র হলে বাকি রুটগুলোও বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সরকারের দ্বারা বরিশাল বিভাগে নদ-নদী ড্রেজিংয়ের জন্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২৮ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ হলেও, চলতি বছর বরাদ্দের সঠিক পরিমাণ সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট তথ্য জানানো হয়নি। তবে বলছে, পুরো অর্থই ড্রেজিং কাজে ব্যয় করা হয়েছে। অতিরিক্ত পলি জমে নদীর নাব্যতা রক্ষায় বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।
নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন-উর-রশীদ বলেন, ‘নদীর পলির কারণে নাব্য সংকট সৃষ্টি হয়। বরাদ্দ অনুযায়ী ড্রেজিং চলছে, ভবিষ্যতেও বরাদ্দের পুরো অর্থ ব্যয় করে নদীপথ সচল রাখার চেষ্টা থাকবে।’






