গত ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের থাবার পর সাত মাস সময় পার হয়েছে। পরিস্থিতির আকস্মিকতায় শুরুতে প্রায় গোটা বিশ্ব থমকে গেলেও ধীরে ধীরে সচল হচ্ছে অর্থনীতি। গতি পাচ্ছে রপ্তানি বাণিজ্য। গত মার্চ ও এপ্রিল মাসে বড় ধাক্কা খেলেও মে থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বাংলাদেশের রপ্তানি।
করোনার ধাক্কায় গত মার্চে বাংলাদেশের রপ্তানি কমেছিল ১৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। এপ্রিলে প্রায় ৮৩ শতাংশ, মে মাসে ৬২ শতাংশ কমেছিল। জুনে এসে কিছুটা স্বস্তি মেলে। রপ্তানি আড়াই শতাংশ কমলেও তা সহনীয় ছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই-আগস্টে কমেনি, বরং বেড়েছে ২ দশমিক ১৭ শতাংশ। জুন থেকে রপ্তানি এভাবে ঘুরে দাঁড়াবে, তা এপ্রিলে রপ্তানিকারকরা চিন্তা করতে পারেননি। অনেকেরই ধারণা ছিল আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত করোনার কারণে বিশ্ববাণিজ্যে গতি আসবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে এসে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন তারা। তবে তাদের বড় অংশই বলছেন, কারখানার উত্পাদন সক্ষমতার এখনো ৩০ ভাগের মতো ব্যবহার করা যাচ্ছে না অর্ডার স্বল্পতায়। তবু যে ৭০ ভাগ ব্যবহার করা যাচ্ছে, তাতে মুনাফা না হোক অন্তত খরচ উঠানো (ব্রেক ইভেন পয়েন্ট) সম্ভব হবে বলে মনে করছেন।
তবে রপ্তানিকারক এবং আমদানিকারকদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, পরিবর্তন হয়ে গেছে রপ্তানি বাণিজ্যের ধরন। আগে যে কোনো বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান তিন চার মাস আগেই ক্রয়াদেশের বিষয়টি ফয়সালা করতেন। অর্থাত্ তিন থেকে চার মাসের লিড টাইম (ক্রয়াদেশ পাওয়ার পর পণ্য তৈরি করে জাহাজীকরণ পর্যন্ত সময়) পেতেন রপ্তানিকারকরা। ফলে সহজেই অনুমান করা যেত, আগামী চার মাস পর্যন্ত কী পরিমাণ রপ্তানি হতে পারে। বর্তমানে তা পরিবর্তন হয়ে গেছে, বিদেশি বায়াররা তাদের স্টোরে বেশি পরিমাণ পণ্য আটকে রেখে ঝুঁকি নিতে চান না। পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায়, চাহিদা ফের কমে যায় কি না কিংবা চলমান ডিজাইন ও ফ্যাশনে কোনো পরিবর্তন আসে কি না—এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে লোকসান কমাতে তারা এখন ক্রয়াদেশ ভাগ ভাগ করে অল্প পরিমাণে দিচ্ছেন। ফলে দুই মাস পর রপ্তানির কী পরিস্থিতি, তা আন্দাজ করা যাচ্ছে না। এমনকি এক মাস পরের পূর্বাভাসও দিতে পারছেন না অনেকেই।
বাংলাদেশের রপ্তানির ৮৪ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। অন্যদিকে আমাদের রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশই যায় ইউরোপের ২৮টি দেশ এবং আমেরিকার বাজারে। এসব দেশে ধীরে ধীরে দোকান খুলতে শুরু করলেও সেখানে ক্রেতারা এখনো পুরোদমে দোকানমুখী হচ্ছে না। ক্রেতাদের একটি বড় অংশই বাসায় থেকে অনলাইনে পণ্যের অর্ডার দিচ্ছে। ক্রেতার চাহিদার ওপর ভিত্তি করে দ্রুতই নতুন নতুন ডিজাইনের দিকে যেতে হচ্ছে। এসব কারণেও তারা অল্প পরিমাণে অর্ডার দিচ্ছে। কিন্তু আগের মতো তিন-চার মাসের লিড টাইম পাওয়া যাচ্ছে না। এখন এক থেকে দুই মাসের সময় দিয়ে পণ্য পাঠানোর জন্য তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে রপ্তানির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখন উড়োজাহাজে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অন্যতম বড় ক্রেতা এইচএন্ডএম এবং মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার। এসব ব্র্যান্ডের বাংলাদেশ অফিসের কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, আগের মতো একবারে বেশি পরিমাণ অর্ডার দিচ্ছেন না তারা। বরং ছোট ছোট লটে অর্ডার দিচ্ছেন। লিড টাইম প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হয়েছে। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত স্বল্পমূল্যের (ব্যাসিক আইটেম) রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাড়তি সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের সামনে। কেননা করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী মানুষের আয় কমে যাওয়ায় তুলনামূলক কম দামের পোশাকের বিক্রি বেড়ে গেছে। এর প্রমাণ হলো ওয়ালমার্টের মতো ব্র্যান্ডের পোশাকের বিক্রি বেড়েছে সম্প্রতি। এই ব্র্যান্ডটি অপেক্ষাকৃত স্বল্প মূল্যের বেসিক আইটেম বিক্রি করে বলে তাদের বিশেষ পরিচিতি রয়েছে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে উত্পাদনকারীদের পূর্বপ্রস্তুতি থাকতে হবে। আগে যেমন অর্ডার পাওয়ার পর তৃতীয় দেশ থেকে কাঁচামাল ও এক্সেসরিজ আমদানি করে তা দিয়ে পণ্য তৈরি করে পাঠানো যেত, বর্তমান বাস্তবতায় তা সম্ভব হবে না। এজন্য স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল ও এক্সেসরিজ জোগানের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ফলে একটি চলতি মূলধন প্রয়োজন হবে। পরিবর্তিত ফ্যাশন ও ডিজাইন অনুযায়ী পণ্য তৈরির সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।