গাজায় চলমান যুদ্ধ নিয়ে সম্প্রতি এক বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সাবেক চিফ অব স্টাফ হারজি হালেভি। তিনি জানান, এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত দেশটির ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে মোট দুই লাখেরও বেশি মানুষ নিহত বা আহত হয়েছে। তিনি স্বীকার করেন, এই সামরিক অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি বা তার অধীনস্থ অন্যান্য কর্মকর্তারা কোনো আইনি পরামর্শের তোয়াক্কা করেননি, যা একটি বড় স্বীকৃতি।
প্রথম ১৭ মাস ধরে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেসের (আইডিএফ) নেতৃত্ব দেওয়া হালেভি গত মার্চে তার পদত্যাগের সময় ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানকে জানান, গাজার ২২ লাখ মানুষের মধ্যে অন্তত ১০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা প্রায় ২ লাখের বেশি মানুষ। তার এই গণনাটি গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে তথ্য দিয়েছে, তারই সাথে মিলছে; তবে আগে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এই তথ্যকে ‘হামাসের প্রোপাগান্ডা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলো এই সংখ্যাকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করেছে, কারণ তারা জানিয়েছে এই হিসাবটি নির্ভরযোগ্য।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় নিহতের সংখ্যা ৬৪,৭১৮ জন এবং আহত হন ১৬৩,৮৫৯ জন। আশঙ্কা করা হয়, ধ্বংসীয় এই যুদ্ধের ফলে বহু মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আহত বা নিহত হয়ে থাকতে পারে। গত শুক্রবার, গাজা সিটির আশপাশে ইসরায়েলি হামলায় আরও ৪০ জনের মৃত্যু হয়।
আন্তর্জাতিক মানবিক তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত নিহতের ৮০ শতাংশের বেশি বেসামরিক নাগরিক। অন্যদিকে, ৭ অক্টোবরের হামলায় প্রায় ১,২০০ মানুষ নিহত হন, এর মধ্যে ৮১৫ জনই ইসরায়েলি ও বিদেশি নাগরিক। নিহতদের মাঝে অনেক সামরিক সদস্যও ছিলেন।
হালেভি এক সভায় বলেন, ‘এটি কোনো কোমল যুদ্ধ নয়, আমরা প্রথম মিনিট থেকেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।’ তিনি দাবি করেন, ৭ অক্টোবরের আগেই ইসরায়েল আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। যদিও তিনি বলছেন, আইডিএফ আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের মধ্যে থেকেই কাজ করে, তবে স্বীকার করেন যে তিনি কখনোই আইনি পরামর্শের গুরুত্ব দেননি।
তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘কেউ আমাকে একবারও থামায়নি। জেনারেল ইফাৎ টি’ওমের-ইয়ারুশালমি, যিনি সামরিক আইনজীবী, তারাও নয়।’ তবে, বিভিন্ন সূত্র বলছে, এই বিষয়ে সরাসরি রেকর্ডিংয়ে হালেভির মন্তব্য ছিল না। পত্রিকা আরও জানায়, হালেভির দৃষ্টিতে সামরিক আইনজীবীদের মূল কাজ হলো- আইডিএফের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বৈধ হিসেবে উপস্থাপন করা।
আইডিএফের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে, ইসরায়েলি মানবাধিকার আইনজীবী মাইকেল সোফার্দ বলেন, হালেভির বক্তব্য নিশ্চিত করেছে যে, এই সামরিক আইনজীবীরা কার্যত ‘রাবার স্ট্যাম্প’ হিসেবে কাজ করে থাকেন।
এদিকে, হারেৎজের প্রতিবেদনে জানানো হয়, হালেভির উত্তরসূরি, বর্তমান আইডিএফ চিফ অব স্টাফ ইয়াল জামিরও সামরিক আইনজীবীদের আইনি পরামর্শ উপেক্ষা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, গাজা সিটিতে প্রায় ১০ লাখ মানুষকে দক্ষিণে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলেও, তৎকালীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় সেখানে থাকা মানুষজনের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে। এর ফলে, অনেক ফিলিস্তিনি হয়তো সেইসব আঘাত বা ধ্বংসের শিকার হয়েছেন, যারা নিরাপদ স্থানে যেতে পারেননি কিংবা যেতে চাননি।
এছাড়া, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে যে প্রস্তাব পাস হয়েছে, সেটি ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। এতে বলা হয়, ৭ অক্টোবরের হামাসের হামলা নিন্দনীয় এবং গাজায় ইসরায়েলি হামলা, অবরোধ ও মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের জন্য আন্তর্জাতিক সমালোচনা। এই প্রস্তাবটি উদ্বেগজনক মানবিক বিপর্যয় বন্ধের জন্য দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপের আহ্বান জানান। একইসাথে, দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের জন্য নির্দিষ্ট ও সময় নির্ধারিত পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও বলা হয়।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আগে থেকে বলে দিয়েছেন, ফিলিস্তিন কখনোই স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাবে না। এই মন্তব্যের সঙ্গে তিনি জাতিসংঘের সিদ্ধান্তগুলোও প্রত্যাখ্যান করেন। তবে জাতিসংঘের পক্ষে থেকেই নিশ্চিত করা হয়, তারা নিজস্ব রায় ও সিদ্ধান্তে অটল থেকে এই প্রস্তাবের পক্ষে অবস্থান নেয়। হামাসও এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে এবং এটিকে দ্বিরাষ্ট্র সমাধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বলে মনে করছে। ভবিষ্যতে কিছু দেশ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে পারে বলে ধারণা প্রকাশ করা হয়েছে।