নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের বুক চিরে বয়ে যাচ্ছে শীতলক্ষ্যা নদী। এই নদীর দু’পাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য জাহাজ তৈরির কারখানা, যা এখানে লক্ষাধিক মানুষের জীবিকা নির্বাহের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিদিনই এখানে চলে দিনরাত্রির কাজ, যেখানে নানা ধরণের শ্রম ও কারিগরির জোয়ার দেখা যায়। কেউ জ্বালা দেয়, কেউ গ্রান্ডিং করছে, কেউ ডিজাইন করছে, আবার কেউ প্লেট কাটছে বা রঙ করছে। এর পাশাপাশি পাহারাদাররাও কাজ করে যোগ দিয়ে। নদীর তীরের এই জাহাজ নির্মাণ ও রমজান, পুরানো জাহাজ কাটা, নতুন ও পুরানো জাহাজের বেচাকেনার এই ক্রিয়াকলাপের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে একটি বিশাল বাজার সৃষ্টি হয়েছে। পথ চলতে গেলে টুকরো টুকরো শব্দে পথচারীরা অবচেতন থাকেন, কান ঝাঁপিয়ে পড়ার উপক্রম হয়।
ডেমরা থেকে বালুআয় নদীর পশ্চিম তীর ধরে উত্তরে কালো অজগরের মতো লম্বা পিচঢালা সরু পথে চলতে পারে, যা মাত্র তিন কিলোমিটার হলেও এই পথের দুই পাশে দেখা যায় অসংখ্য জাহাজ নির্মাণের কারখানা। এক সময়ের ভবঘুরে, এখন কোটি কোটি টাকার মালিক হিসেবে পরিচিত সুজন মিয়া বলেন, ‘এক সময় কাজের সন্ধানে ছুটতাম, এখন আমার অধীনে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করে। আমি প্রথম বালুমাটির তীরের এই ছোট ছোট কারখানায় শুরু করেছিলাম, এরপর ১৯৯০ দশকের দিকে আমার উদ্যোগে ‘থ্রি-স্টার’ নামে একটি ডকইয়ার্ড চালু করি। এরপর থেকে এই শিল্প দ্রুত বিকাশ লাভ করে, এখন হাজারো জাহাজ তৈরি হচ্ছে এখানে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই এলাকার ইটাখোলা একসময় নির্জন ছিল, এখন সত্যিই কর্মমুখর জনপদে রূপ নিয়েছে।’
এছাড়া এখানে রয়েছে বালুরপাড়, ইদেরকান্দি, পূর্বগ্রাম, ভাওয়ালীয়াপাড়া, ডাক্তারখালী, বড়ালু, মাঝিনা, হড়িনা ও ইছাখালীর চরে প্রায় অর্ধশতাধিক জাহাজ তৈরির কারখানা। পাশাপাশি মুড়াপাড়া ইউনিয়নের গঙ্গানগর ও দড়িকান্দির চরে রয়েছে আরো ৮ থেকে ১০টি কারখানা। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মাষ্টার ডকইয়ার্ড, থ্রিস্টার ডকইয়ার্ড, ফাইভ ইস্টার, খান, ফাহিম, শামস, তালহা, আমির, মালেক, রাজু, লিটন, ফটিক, ভাই ভাই, মনির ডকইয়ার্ড, আর এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অনেককারিগর। এসব কারখানায় ৫০ থেকে ১৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের কোষ্টার বা মালবাহী জাহাজ, সরোঙা, ফেরি, জেটি, পল্টন, বালুবাহী ট্রলার, বলগেট ও ড্রেজার তৈরি হয়।
জাহাজ তৈরিতে মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয় লোহার প্লেট ও এঙ্গেল। এই সামগ্রীগুলো মূলত চীন থেকে আমদানি করা হয়। এ ছাড়া টি-গার্ডার, বিট-গার্ডার, রং, ইট, বালি, সিমেন্ট, গ্যাস সিলিন্ডার, অক্সিজেন, ওয়েল্ডিং রড এবং কিছু খুচরো উপকরণ প্রয়োজন হয়।
একটি বড় কোষ্টার জাহাজ বানানোর জন্য প্রথমে রাজমিস্ত্রি বেইস লাইন প্রস্তুত করেন। এরপর ঠিকাদারের নির্দেশে ফিটাররা জাহাজের মূল কাঠামো নির্মাণ করেন। ওয়েল্ডাররা ঝালাইয়ের মাধ্যমে জাহাজের খাকি বা শেল তৈরি করে। একটি বডি দাঁড়ানোর পর, সেখানে মেশিন ইনস্টলেশন এবং রঙের কাজ চলতে থাকে। বড় জাহাজে সাধারণত ৩-৪টি খুপড়ি বা হেস থাকে, যেখানে একসঙ্গে ৩ থেকে ৪শ টন মাল বহন করা যায়।
শীটগুলো আসে চট্টগ্রাম থেকে, যেখানে বিদেশী কাটা জাহাজের ৮ থেকে ১২ মিলিমিটারের শীট ব্যবহৃত হয়। শীটের দাম কেজিতে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। লোহার অঙ্গেল পাওয়া যায় স্থানীয় বাজারে ৭৫-৭৬ টাকা কেজি দরে। অপরদিকে, ৮-৯ লাখ টাকায় চীন থেকে আসা জাহাজের বেশিরভাগ মেশিন ও অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করা হয়। এর জন্য ঢাকায় বংশালের অথবা চট্টগ্রামের ভাটিয়া এলাকায় যায় মালামাল।
প্রায়শই, এক বড় জাহাজ তৈরিতে মোট খরচা উপস্থিত হয় ৯ থেকে ১০ কোটি টাকা। এরপর মালিকরা সুবিধামত লাভ করে তা বিক্রি করেন। সাধারণত, এক জাহাজ নির্মাণের সময় লাগে ১২ থেকে ১৫ মাস, যেখানে ২০ থেকে ২৫ জন কারিগর কাজ করে থাকেন।
শ্রমিকরা যেমন ফিটার আমির, মোজ্জামেল, মোক্তার, জয়নাল, ওয়েল্ডার পান্নু, আলমাছ, আনোয়ারসহ অন্যরা জানান, হিসেব কষে তারা খেয়ে পড়ার পর বাকি টাকা পরিবারের জন্য সংরক্ষণ করেন। এর মধ্যে বেতনের পরিমাণ খুবই কম, তবে তারা অন্য কাজ শিখতে পারেননি।
অন্যদিকে, জাহাজের মালিকরা বলে থাকেন, রোজ হাজিরা, মালামাল কেনা, বিদ্যুৎ বিল, জমির ভাড়া এই সব খরচার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে জাহাজের লাভ-ক্ষতির হিসেব। এই কারণে তারা সময়মতো টাকা দেন সকল কারিগর ও শ্রমিকের হাতে। এছাড়া, বিশ্বব্যাপী সামগ্রীর দাম বাড়লেও, জাহাজের মূল্য অপ্রকাশ্যে থাকে বা অপেক্ষাকৃত কমে যায়। এখন পর্যন্ত এই শিল্পে বিকাশের কারণে, নির্জন এই ইটাখোলা এখন শ্রমজীবী ও কর্মমুখর এক জনপদে পরিণত হয়েছে।






