বাংলাদেশে টেস্ট ক্রিকেটের পথচলা শুরু হয়েছে গত ২৫ বছর আগে, এ সময়ে আমরা স্বপ্ন দেখেছি দেশের জন্য কিছু করে দেখানোর, সেরাদের কাতারে যেতে। কিন্তু বাস্তবতা অনেকটাই আলাদা। রজতজয়ন্তীতে সাবেক অধিনায়কেরা ফিরে দেখছেন অতীতের কিছু স্মৃতি, বর্তমানের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছেন এবং ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত চিন্তাভাবনা করছেন। তারা বলছেন, অল্পতেই সন্তুষ্ট হয়ে আরও অনেক কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এখনো আমাদের মধ্যে জেগে উঠেনি। যখন আমরা প্রথমবার টেস্ট খেলেছি, তখন আমাদের স্বপ্ন ছিল টেস্টের সেরা চার দলের মধ্যে থাকা, কিন্তু তা এখনো দূরের কথা। অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে আমরা পা মেলানোও বেশ যায়নি।
টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার সময় আমাদের নিজস্ব কোন মাঠ ছিল না, অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধাও খুবই কম ছিল। বর্তমানে অনেক মাঠ তৈরি হয়েছে, খেলোয়াড়েরা উন্নত সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তবে আমরা ওই পর্যায়ের উন্নতি করতে পারিনি। আরও এগিয়ে যেতে পারতাম, তবে সেই জন্য প্রয়োজন ছিল সঠিক পরিকল্পনা ও নিয়মানুযায়ী উন্নয়ন।
পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে আরও ১০-১৫ বছর আগে, কম সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সাকিবের মতো খেলোয়াড়রা ওঠে এসেছেন। আমাদের বড় সমস্যা হলো—কোনো কিছু পেতে পেতে যতটা সন্তুষ্টি হয়, ততটাই অল্পতেই আমাদের হৃদয় ভেঙে যায়। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে যেমন সাকিব, তামিম, মাশরাফি, আশরাফুল, মুশফিক, মুমিনুলের মতো ক্রিকেটাররা স্বনির্ভর হয়েছেন, কিন্তু দল হিসেবে এখনো প্রত্যাশায় ধাক্কা খাচ্ছি।
এই ব্যর্থতার জন্য আমাদের সবারই দায় আছে। কাঠামোগত উন্নয়ন অনিয়মিত ছিল, ঘরোয়া ক্রিকেটের মানোন্নয়ন ও সুস্থ কাঠামো গড়ে তোলায় অবহেলা করা হয়েছে। ফলে, প্রতিযোগিতামূলক মানোন্নয়ন হয়নি, ভালো সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারিনি। অনেকে বলবেন, সুযোগ-সুবিধা না থাকায় তারা ভালো খেলোয়াড় হতে পারেননি। তবে, এর আগের সময়েও সাকিবরা কম সুযোগেও নিজের অবস্থান গড়েছেন।
অতীতের চার প্রজন্মের ক্রিকেটারদের কথা ভাবলে বোঝা যায়, আমাদের ক্রিকেটের ইতিহাসে অনেক উত্কর্ষের মুহূর্ত ছিল। শুরুতেই বুলবুল ভাই আমিনুল ইসলাম সেঞ্চুরির মতো বড় অর্জন করেছেন। এরপর আসে আশরাফুল, যিনি খুব দ্রুতই সিনিয়রদের পেছনে ফেলে টেস্টে প্রবেশ করেন। তারপরে এসেছে মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক—তাদের মধ্যেও কেউ তাদের আগের তুলনায় এগিয়ে যেতে পারেনি। কেউ যদি চায় চীনে গিয়ে ব্রায়ান লারার মতো হতে, তা সম্ভব নয়। কারণ, তার জন্য দরকার সেই সংস্কৃতি ও পরিবেশ, যা বাংলাদেশে এখনো গড়ে উঠেনি।
খালেদ মাসুদ, দেশের সাবেক অধিনায়ক, বলেন, বর্তমানে ভারত, অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ডের অবস্থান থেকে বাংলাদেশে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। হয়তো প্রযুক্তি বা ক্লাবের আধুনিকতা কিছু বদল আনবে, কিন্তু ইতিহাসে ভুল পরিকল্পনা, ভুল নেতৃত্ব ও সিস্টেমের কারণে আমরা অনেক পিছিয়েছি। অবকাঠামো উন্নয়ন হয়নি, খেলাধুলার পরিবেশও সেভাবে গড়ে ওঠেনি।
অথচ, বাংলাদেশে এখনও অনেক সুযোগ-সুবিধা থাকলেও তা যথাযথ ব্যবহৃত হচ্ছে না। মিরপুর যেখানে আমাদের কেন্দ্রবিন্দু, সেখানে এখনো পর্যাপ্ত আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নেই। তিন বছর আগে ভারতের রায়পুরে গিয়েছিলাম, যেখানে আইপিএল হয়নি, কিন্তু সেখানে সুযোগ-সুবিধা অনেক উন্নত। পরিকল্পনা ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবের কারণেই আমাদের ক্রিকেট এগোচ্ছে ধীর গতিতে।
আমাদের উচিত ছিল আরও উন্নত পর্যায়ে থাকা, ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং বড় রান করার অভ্যাস গড়ে তোলা। দেশের বাইরে থেকে প্রতিযোগীদের মতো বড় ইনিংস খেলার মানসিকতা আমাদের তৈরি করতে হবে। আমরা চাই, আমাদের ব্যাটসম্যানরা বড় ইনিংস খেলুক, মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকুক। তবে সে জন্য দরকার মানসিক দৃঢ়তা এবং ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত খেলার অভ্যাস।
আধুনিক ক্রিকেটে সাদা বলে খেলে টাকা ও সুবিধা বেশি, এটাই এখন সাধারণ নিয়তি। তবে, কোচেদের দায়িত্ব হলো খেলোয়াড়দের বুঝিয়ে দেওয়া যে, বড় ইনিংস খেলতে গেলে শুধু ফিটনেসই যথেষ্ট নয়, মানসিক প্রস্তুতিও জরুরি। কঠিন সময় মোকাবেলা করতে শেখা, পরিশ্রম করা, মাঠে ফাইট করা—এসব বড় ইনিংসের জন্য অপরিহার্য। আমাদের খেলোয়াড়দের মাঝে বড় রান করার আবেগ থাকলেও, সেটি যথাযথভাবে প্রবল না, মানসিক দৃঢ়তা ও নিয়মিত খেলোয়াড়ি অভ্যাস গড়ে তোলা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
অবশেষে, আমি একটি দাবি বলতে চাই—সাদা বলের ক্রিকেটে কেন টাকাপয়সা বেশি, এটাই এখন সবাই মুখস্ত। কিন্তু, গুরুত্বপূর্ণ হলো কোচদের দায়িত্ব, যাতে খেলোয়াড়রা বুঝতে পারে, সত্যিকার উন্নতির জন্য লাল বলের ক্রিকেট খেলতেই হবে। প্রযুক্তি ও আধুনিকতার মাঝে যেন এই মূল সত্যটি অটুট থাকে, সেটাই আমাদের ভবিষ্যতের প্রধান চ্যালেঞ্জ।






