রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে কিয়েভে তৈরি হয়েছে এক অনিশ্চয়কর পরিস্থিতি। ইউক্রেনের জন্য এখন ভাবনা হচ্ছে, মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষা করবেন নাকি তাদের সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো হারাবেন। এই কঠিন পরিস্থিতিতে দেশের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, এটি এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। তাঁরা একদিকে দেশের সার্বভৌম মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত সমাধানের পথে যেকোনো মূল্য দিতে প্রস্তুত হচ্ছেন। শুক্রবার প্রেসিডেন্ট কার্যালয় থেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেশের নাগরিকদের উদ্দেশে জেলেনস্কি জানান, “এটি আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময়। এখন ইউক্রেনের সামনে খুবই কঠিন সিদ্ধান্ত। মর্যাদা হারানো বা গুরুত্বপূর্ণ মিত্রকে হারানোর ঝুঁকি।” তিনি আরও বলেন, “আমি ২৪ ঘণ্টা লড়াই চালিয়ে যাব, যেন এই প্রকল্পের অন্তত দুইটি বিষয়—আমাদের মর্যাদা ও স্বাধীনতা—বিচ্ছিন্ন না হয়।”
প্রায় চার বছর আগে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ২৮ দফার এক প্রস্তাব পাঠায় যা যুদ্ধের সমাপ্তির জন্য। সেই প্রস্তাবের বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে এই প্রস্তাবের সঙ্গে সম্মতি পাওয়া উপযুক্ত হবে। রয়টার্সের খবরে জানানো হয়, এই পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্র কিয়েভকে নৈতিক ও সেনাবাহিনীর তথ্য, অস্ত্র সহায়তা বন্ধের হুমকি দিয়েছে। এ ব্যাপারে বলা হচ্ছে, রাশিয়ার দীর্ঘদিনের দাবি মেনে নেওয়া, অর্থাৎ ইউক্রেনের কিছু এলাকা ছাড়িয়ে যাওয়া, সেনা কমানো, ন্যাটোতে যোগদান না করা—এসব শর্তে আলোচনা চলছে। বদলে রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলবে, মস্কোকে আবার জি ‘৮’ এ অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হবে।
অন্যদিকে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলছেন, এই প্রস্তাবটি ‘আলাস্কা বৈঠকের আলোচনা’র আধুনিক সংস্করণ। তিনি জানিয়েছেন, এই পরিকল্পনাটি ‘চূড়ান্ত শান্তিচুক্তির জন্য ভিত্তি হতে পারে’, তবে এখনো এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়নি। পুতিনের কথায়, “ইউক্রেন এটি মানতে নারাজ, আর তাদের ইউরোপীয় মিত্ররাও এখনো মনে করছে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে কৌশলগতভাবে হারানোর আশা আছে।”
এমন পরিস্থিতিতে ইউক্রেনে চলমান আক্রমণও জটিল হয়ে উঠছে। পশ্চিমাঞ্চলীয় টারনোপিলে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ৩১ জন নিহত ও ৯৪ জন আহত হয়েছে। ক্রেমলিন দাবি করছে, খারকিভের ওস্কিল নদীর পূর্ব তীরে প্রায় ৫ হাজার ইউক্রেনীয় সেনা আটকা পড়েছে। কিয়েভ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। এছাড়া, পোকরোভস্ক ও মিরনোহ্রাদ শহর দখলে রাশিয়ার তীব্র লড়াই চলছে এবং দক্ষিণের জাপোরিঝঝিয়াতেও মস্কো অগ্রসর হচ্ছে। ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলছেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার অগ্রগতি জেলেনস্কি ও তার মিত্রদের বুঝিয়ে দেবে যে, এখনই আলোচনা করতে বসা অনেক ভালো ছিল।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় ইউক্রেনের সামরিক সক্ষমতা কমছে, যার ফলে কিয়েভ চুক্তির দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য হতে পারে। একজন বিশ্লেষক জিম টাউনসেন্ড বলেছেন, ‘যদি যুক্তরাষ্ট্র বলে—যদি তোমরা রাজি না হও, তাহলে আর সহায়তা দেব না—তাহলে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির জন্য চুক্তি গ্রহণের চাপ অনেক বেড়ে যাবে।’
অন্যদিকে, ইউরোপও এই মার্কিন পরিকল্পনা সম্পর্কে আগে জানানো হয়নি। শুক্রবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টার্মার এবং জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মার্শ সম্মতি দিয়েছেন, তবে ইউক্রেনের অটল সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইউরোপের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কায়া কালাস বলেন, ‘আমরা সবাই যুদ্ধের সমাপ্তি চাই, কিন্তু কীভাবে তা হবে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়ার কোনো অধিকার নেই ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব থেকে ছাড় নিয়ে যাওয়ার।’ ডমিনিক কেইন জানান, ইউরোপ সমর্থনে ঐক্য থাকলেও, কোন ছাড়গুলি গ্রহণযোগ্য হবে তা এখনো বড় প্রশ্ন। তাঁর মতে, এই সিদ্ধান্তের জন্য চূড়ান্ত ভাবেই মূলত মুখোমুখি হবে মস্কো, কিয়েভ ও ওয়াশিংটন।






