প্রতিবার শীতের শুরুতে বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে অনেক অপরিচিত ও রঙিন অতিথি পাখি আমাদের দেশে আসে। নদী, বিল, জলাশয় ও পুকুর এই সব জায়গায় তাদের কাকলিতে জলজ অনুষ্ঠানে মেতে ওঠে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের রাউজানে এই অতিথিপাখিদের আগমন খুবই নিয়মিত ও অপরিহার্য ঘটনা। হালদা নদী, ঈসা খাঁ দিঘি, পরীর দিঘি, ইউসুফ খাঁ দিঘি, নরসরত বাদশা দিঘি, জল পাইন্ন্যা দিঘি, রায় মুকুট দিঘি, ভিক্ষু ভানুপুর দিঘিসহ বিভিন্ন বড় জলাশয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা এসে জলখেলিতে মেতে ওঠে। এ পাখিরা খুব কম দূরত্ব থেকে আসে না। বেশির ভাগ অতিথি পাখির আগমন হিমালয় অঞ্চল, হিমালয়-পূর্ব তিব্বত, লাদাখ থেকে শুরু করে সেন্ট্রাল এশিয়া ও সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে। তারা বরফ কেটে উষ্ণ ও পথপ্রদর্শক পরিবেশের আশ্রয় খুঁজে নেয়। এছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকেও পাখিরা আসে। এই পাখিগুলি কয়েক মাস এখানে থাকার পর আবার ফিরে যায় নিজেদের স্বাভাবিক পরিবেশে। তবে এদের শিকার করা একেবারেই দণ্ডনীয় অপরাধ, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোরভাবে মোকাবিলা করে থাকে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগও রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, শীতকালে এই দেশে আসা অতিথি পাখিদের মধ্যে রয়েছে- সোনাজঙ্গ, খুরুলে, কুনচুষী, বাতারণ, শাবাজ, জলপিপি, ল্যাঞ্জা, হরিয়াল, দুর্গা, টুনটুনি, রাজশকুন, লালবন মোরগ, তিলে ময়না, রামঘুঘু, জঙ্গী বটের, ধূসর বটের, হলদে খঞ্চনা, কুলাউসহ নানা প্রজাতির পাখি। রাউজানের বেশি দেখা যায় ঈসা খাঁ দিঘিতে। এখানে কয়েক হাজার অতিথি পাখির বিচরণ দেখা যায়, ঘন্টার পর ঘন্টা পাখিপ্রেমীরা তাদের কিচিরমিচির ডাক শুনে আনন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে।
প্রতিটি জলাশয়, দিঘি, খাল, বিল এই সব জায়গায় অতিথি পাখির বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে শীতকালীন সময়ে ঈসা খাঁ দিঘিতে অতিথি পাখির আগমন ব্যাপক হয়। এই পাড়ের সকল মানুষ তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আন্তরিকভাবে কাজ করে যান। পাখিদের দেখভালের জন্য স্থানীয়রা ভিড় তোলে, কেউ কেউ ছবি তোলে, তাদের সঙ্গে প্রকৃতির এই সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করে।
বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে, পৃথিবীতে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির অস্তিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে পাওয়া যায় ৭১৪ প্রজাতি, যার মাঝে প্রায় ৩২০টি প্রজাতি অতিথি পাখি। শীতকালে এরা আসে দেশে, বিশেষ করে পানিতে ভরা জলাশয়, দিঘি ও খালে। রাউজানের জলাশয়ে দেখা যায় সোনাজঙ্গ, বাতারণ, খুরুলে, কুনচুষী, ল্যাঞ্জা, শাবাজ, জলপিপি, হরিয়াল, দুর্গা, ধূসর বটের, কুলাউসহ নানা প্রজাতির পাখি। এছাডা, গ্রুপে আসে ধূসর ও গোলাপি রাজহাঁস, বালি হাঁস, সরালি, পাতিহাঁস, নীলশীর পিয়াং, কালোহাঁস, রাঙামুড়ি, চখাচখি, পানি মুরগি ও কমনচিল।
সম্প্রতি উপজেলার নোয়াপাড়া পুলিশ ক্যাম্পের বিপরীতে শিব মন্দিরের বিশাল পুকুরে দেখা গেছে শত শত অতিথি পাখি কিচিরমিচির শব্দে জলকেলিতে ব্যস্ত। এই পুকুর পাড়ের বাসিন্দারা বলেন, ভোরের আলোতেই পাখির ডাকের মধ্য দিয়ে ঘুম ভাঙে তাদের। শীতের শুরুতেই হাজার হাজার অতিথি পাখি নেমে আসে ঈসা খাঁ দিঘিতে। এই দিঘির আশেপাশে ইউনিয়ন পরিষদ ভবন আছে।
স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, লস্কর উজির দিঘিতে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা যায়। ভিনদেশি অতিথি পাখিগুলো স্থানীয় বিনোদনের অন্যতম উৎস। এছাড়া কদলপুরের মানছি পুকুরেও বেশ কিছু অতিথি পাখির দেখা মিলে।
নোয়াপাড়ার জালোয়ার দিঘি এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রতিদিন সকাল ১১ থেকে ১২টার মধ্যে এই দিঘিতে হাজার হাজার পাখি অবস্থান করে। ওড়াউড়ি আর পাখির ডাকে পুরো এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। অনেকেই ঢিল ছুঁড়ে পাখির নাচন দেখতে চান। সন্ধ্যার দিকে এসব পাখি অন্য কোনো স্থানে চলে যায়।
রাউজান উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. জয়িতা বসু জানান, শীতপ্রধান দেশ যেমন হিমালয়, সাইবেরিয়া, রাশিয়া, ফিলিপাইন ও ফিনল্যান্ডের মত অঞ্চল থেকে প্রখর শীতের অভাবে এই পাখিগুলোর জন্য খাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে বাংলাদেশে আসে। এক্ষেত্রে প্রায় ৬-৭ মাস তারা এখানেই থাকে। তিনি সতর্ক করে বলেন, নির্বিচারে শিকার চলতে থাকলে অতিথি পাখির আগমন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। জলাশয় ভরাটের কারণে তাদের বাসস্থান সংকুচিত হচ্ছে। তাই প্রাকৃতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এই পাখিগুলোর রক্ষা জরুরি।






