করোনার মতো সংকট আগে কখনো আসেনি। একদিকে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি, অন্যদিকে কর্ম হারানোর আশঙ্কা। এই সময়ে মানুষের আয় অনেক কমে গেছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের সঞ্চয়ও কমে যাচ্ছে। ফলে মানুষ ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিচ্ছে। এতে ব্যাংকের আমানতও কমে যাচ্ছে। আর আমানতের পাশাপাশি সঞ্চয়পত্র বিক্রয় আগের চেয়ে কমে যাচ্ছে। একই সঙ্গে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে শুরু করেছে। আর শেয়ারবাজারেও চলছে মন্দাভাব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে গ্রাহকের আমানত ছিল ১৪ লাখ ৬২ হাজার ১৯ কোটি টাকা। তিন মাস পর ডিসেম্বর শেষে আমানত দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৯ হাজার ৩৪ কোটি টাকায়। অর্থাৎ, এই সময়ে ব্যাংক খাত থেকে ৫২ হাজার ৮৪ কোটি টাকা চলে গেছে।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, করোনার প্রভাব যখন কাটতে শুরু করেছে, সেই সময় ৫২ হাজার ৮৪ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে অন্য খাতে চলে গেছে। এতে টাকা পাচারের আশঙ্কা করছেন তারা। তাদের মতে, করোনার সময় বহির্বিশ্বে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির থাকায় টাকা বাইরে যেতে পারেনি, যে কারণে আমানত প্রবাহ বেড়েছিল অস্বাভাবিক গতিতে। সেই তুলনায় এই সময়ে আমানত কমে যাওয়াটা অস্বাভাবিক। অথচ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোতে আমানত বেড়েছিল ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে জুলাই থেকে জানুয়ারি—এই সাত মাস যখন পুরোপুরি করোনার সময় ছিল, সে সময় আমানত বেড়েছিল ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমানতের প্রবৃদ্ধি কমেছে ৪৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ বা ৫১ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। ব্যাংক থেকে আমানত কমে অন্য খাতে গেল কি না, সে বিষয়ে দেখা যায় অন্যান্য খাত যেমন সঞ্চয়পত্র ও শেয়ারবাজারে সেই অর্থ যায়নি।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের অথ্যানুযায়ী, সঞ্চয়পত্র বিক্রি অর্ধেকের বেশি কমেছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে, অর্থাৎ এই সাত মাসের হিসাবে ১২ হাজার ১৭৬ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে অর্ধেকেরও কম। গত অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার কম থাকায় কয়েক বছর ধরে বাড়ছিল সঞ্চয়পত্র বিক্রি। কিন্তু এবার কমে যাচ্ছে। সবশেষ জানুয়ারি মাসে ২ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। গত বছরের জানুয়ারিতে বিক্রি হয়েছিল ৫ হাজার ২১৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। তবে ডিসেম্বরের তুলনায় বেড়েছে জানুয়ারি মাসে।
এদিকে শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি খুব ভালো না থাকায় সেখানে খুব বিনিয়োগ হচ্ছে এমনটা নয়। গত বছরের অক্টোবর থেকে শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি খারাপের দিকে। তারপর উত্থান-পতনে চলছে এই বাজার। আর গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন-রুশ সংঘাতের পর দেশের শেয়ারবাজারে টানা দরপতন দেখা দেয়। এতে গত সোমবার পর্যন্ত শেষ আট কার্যদিবসের মধ্যে সাত কার্যদিবসেই পতন দিয়ে পার করেছে শেয়ারবাজার। ধারাবাহিক দরপতনের মধ্যে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ৪৯২ পয়েন্ট কমে যায়। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল মঙ্গলবার শেয়ারবাজারে লেনদেনের শুরুতে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দরপতন হতে থাকে। লেনদেনে অংশ নেওয়া বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের দরপতন হওয়ায় সকাল ১০টা ৫২ মিনিটের মাথায় ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ১৩৮ পয়েন্ট পড়ে যায়। এরপর শেয়ারবাজার পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সেখানে বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা জানায় বিএসইসি।
ব্যাংক আমানত কমে আসার আরেকটা বড় কারণ হিসেবে রেমিট্যান্সের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির কথাও বলা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বছরের সবচেয়ে ছোট মাস ফেব্রুয়ারিতে গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ১৪৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা, যা টাকার হিসাবে (১ ডলারে ৮৬ টাকা ধরে) ১২ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। আগের মাস জানুয়ারিতে ১৭০ কোটি ৪৩ লাখ ডলার বা ১৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রেমিট্যান্স এসেছিল, যা ফেব্রুয়ারির চেয়ে ২১ কোটি ডলার বা ১ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা বেশি।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে স্থবিরতা ছিল, যে কারণে গ্রাহকদের টাকা ছিল ব্যাংকমুখী। করোনার প্রভাব কমায় মানুষের চলাচল বেড়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বিনিয়োগ হচ্ছে। এসব কারণে ব্যাংক থেকে আমানত কমছে। আবার অনেকে আমানতের সুদের হার কম হওয়ায় টাকা ব্যাংকে না রেখে বিভিন্ন স্থানে লগ্নিও করছেন।
আমানত কমে যাওয়ার অর্থ হলো ব্যাংকের বিনিয়োগের সক্ষমতা কমে যাওয়া। আর বিনিয়োগ কম হলে দেশের উৎপাদনও তখন কমে যাবে। ফলে দেশের সার্বিক প্রবৃদ্ধি কমবে।
ব্যাংকের বিনিয়োগ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে কী পরিস্থিতি হয়, কয়েক দফায় দেশের ব্যাংক খাত তা অনুভব করেছে। তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংককে সতর্ক হওয়ার কথা বলেন তিনি।