দেশের বেশির ভাগ মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতার বাইরে থাকায় তাদের পক্ষে আর্থিক লেনদেন বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) তাদের আর্থিক লেনদেনের চমৎকার সুযোগ এনে দিয়েছে। এর সুবাধে শুধু টাকা জমা দেওয়া কিংবা উত্তোলন অথবা অর্থ স্থানান্তর নয়, বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, ভ্যাট ও আয়কর পরিশোধ, ভর্তি ফি প্রদান, স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি জমাকরণ প্রভৃতি কাজ ব্যাংকে না গিয়ে ঘরে বসেই সম্পন্ন করতে পারছে সবাই।
এতে ব্যাংকে যাওয়া-আসার সময় বেঁচে যাচ্ছে, ব্যাংকে সেবা নিতে আসা গ্রাহকদের চাপ কমছে। যাত্রা শুরুর ১০ বছরের মধ্যে সব ধরনের আর্থিক লেনদেনের বড় প্ল্যাটফরমে পরিণত হয়েছে মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান বিকাশ। নতুন করে ঋণ ও আমানতের মতো আর্থিক সেবা যুক্ত করে প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক লেনদেনের পূর্ণাঙ্গ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ফলে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীও এখন ঘরে বসেই টাকা লেনদেনের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসিতে আমানত জমা রাখতে ও সিটি ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্রঋণ নিতে পারছে।
বিকাশসহ নগদ, রকেটের মতো এমএফএস প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরুর পর ব্যাংকে বর্তমানে ছোট অঙ্কের লেনদেন হয় না বললেই চলে। ব্যাংকগুলোও এখন এমএফএস-নির্ভর সেবার বিস্তৃতি ঘটাতে চাইছে। তবে এ প্রবণতাকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। দেশের আর্থিক লেনদেনের বড় অংশ এখনো অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে হচ্ছে। তাই দ্রুতগতিতে সেবা ছড়িয়ে দিতে বিকাশের উদ্যোগটি ইতিবাচক। বিকাশ দিয়ে যে কোনো মোবাইল অপারেটরে রিচার্জ ও প্যাকেজ কেনা যায়।
পাশাপাশি পণ্য ও সেবার মূল্য পরিশোধ করা যায়। গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের ইত্যাদি পরিষেবা বিলের পাশাপাশি ক্রেডিট কার্ডের বিল, স্কুলের বেতন, সরকারি মাশুলও পরিশোধ করা যায়। বিদেশ থেকে বিকাশ হিসাবে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ও আসে। এ ছাড়া ভ্রমণ টিকিট ক্রয়, বিমার প্রিমিয়ামও পরিশোধ করা যায়। পাশাপাশি বিকাশ অ্যাপসের মাধ্যমে এখন দুর্গত ব্যক্তিদের সহায়তাও করা যায়। ফলে বিকাশে এখন প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার কোটি, আর মাসে ৪৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে।
মুঠোফোনে আর্থিক সেবা (এমএফএস) চালুর মাত্র তিন বছরেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং কোটি কোটি গ্রাহকের কাছে পৌঁছে গেছে সরকারি-বেসরকারি খাতের উদ্যোগে চালু হওয়া আরেক এমএফএস সেবা ‘নগদ’। মাত্র কয়েক বছরেই প্রতিষ্ঠানটি এ বাজারে বেশ কিছু ক্ষেত্রে চমক দেখিয়েছে। ঘরে বসেই মুঠোফোনে সহজে হিসাব খোলা, কম খরচে দেশজুড়ে গ্রাহকদের আর্থিক লেনদেন সুবিধা দেওয়া ও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরব উপস্থিতি-এ তিন কারণেই মূলত অল্প দিনেই নগদ পৌঁছে গেছে কোটি কোটি গ্রাহকের হাতের মুঠোয়।
প্রত্যন্ত জনপদ থেকে শুরু করে শহরের গলিপথ—সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে মুঠোফোনে আর্থিক লেনদেনের এ সেবা। নগদের কার্যক্রম শুরুর তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে সরকারি ডাক বিভাগ এবং বেসরকারি কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মিলে নগদ নামে নতুন এমএফএস সেবাটি চালু করে। মাত্র তিন বছরেই এ সেবার মাধ্যমে দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কোটি কোটি গ্রাহক প্রতিদিন গড়ে ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক লেনদেন করছেন। দেশের প্রায় ২৭ হাজার প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের অন্যতম মাধ্যম এখন নগদ। শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজার এজেন্ট সরাসরি যুক্ত নগদের সেবা কার্যক্রমে।
এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের সেবা ব্যবহার করেও নগদ হিসাবে টাকা আনা ও খরচ যাচ্ছে। শুরু থেকেই প্রচলিত আর্থিক সেবার পাশাপাশি গ্রাহকদের ইসলামিক লেনদেন সুবিধা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। মাত্র ৩৬ মাসে নগদ হয়ে উঠেছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এমএফএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। এমএফএস প্রতিষ্ঠান হলেও নগদ এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান নয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। নগদসহ এমএফএস সেবাকে জনপ্রিয় করতে এরই মধ্যে ‘মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বিধিমালা ২০২২’ জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে ব্যাংকের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংকবহিভূর্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানও এমএফএস সেবার কার্যক্রমের জন্য লাইসেন্স পাবে। নগদকে অনুমোদন দিতে কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন এমএফএস সেবা চালুর অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা এবং এই সেবার খরচ কমানোর দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ প্রদান করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে সব ধরনের আর্থিক সেবা বেশ এগিয়েছে। আমাদের দেশে এটি মাত্র শুরু হয়েছে। এসব সেবা চালুর আগে জনগণকে আগ্রহী করে তুলতে হবে। আবার যেসব প্রতিষ্ঠান সেবা দিচ্ছে, তারা কতটা ঝুঁকি বিবেচনা করে সেবাটি চালু করছে, তাও বিবেচনায় নিতে হবে।