সরকার, বেসরকারি খাত এবং কমিউনিটিগুলোর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও অংশীদারিত্বকে শক্তিশালী করে বাংলাদেশ জলবায়ু-স্মার্ট সমাধান গ্রহণে গতি বাড়াতে পারে। এই পদক্ষেপগুলো শুধু ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে না, বরং টেকসই উন্নয়নকেও ত্বরান্বিত করবে। যদি এ ধরনের উদ্যোগগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, তাহলে পরিবার ও প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতাবান হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি সমৃদ্ধির পথে স্থিতিশীল ও সামঞ্জস্যপূর্ণ অগ্রগতি সম্ভব হবে।
গতকাল সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। ওই প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘From Risk to Resilience: Helping People and Firms Adapt in South Asia’—বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের জন্য মানোয়ানুগ অভিযোজনের আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পরিবার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সবচেয়ে বেশি পড়ছে। ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশের কাছে এক অনন্য সুযোগ রয়েছে—সহনশীলতা গড়ে তোলার। আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা ও ঝড়ো মোকাবেলা কেন্দ্রে বিনিয়োগ এরইমধ্যে প্রাণহানির সংখ্যাকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে, যা দেখায় লক্ষ্যভিত্তিক বিনিয়োগ ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্থানীয় অভিযোজন সফলভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে।
ডিসেম্বরে প্রকাশিত রিপোর্ট বলছে, ঘনবসতি, উচ্চ তাপমাত্রা এবং ভৌগোলিক ঝুঁকি থাকায় দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। এই অঞ্চলের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ২০৩০ সালের মধ্যে চরম তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে থাকবে এবং একচতুর্থাংশের বেশি মানুষ ভয়াবহ বন্যার ঝুঁকিতে থাকবে। উপকূলীয় অঞ্চলে পানি ও মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে পানি সংকট এবং জীবনযাত্রার ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।
জলবায়ু সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা জরুরি। আগামী দশ বছরে দেশের তিন ভাগের এক ভাগ পরিবারের ও প্রতিষ্ঠানের জলবায়ু বিপদে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতিমধ্যে, ৬৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠান এবং ৮০ শতাংশ পরিবার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে, তবে বেশিরভাগই উন্নত প্রযুক্তি অথবা সরকারী অবকাঠামো ব্যবহার না করে মৌলিক ও স্বল্পমূল্যের সমাধানে নির্ভরশীল।
বাংলাদেশের ২৫০টি উপকূলীয় গ্রামে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামো এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে দীর্ঘমেয়াদী দুর্যোগ-প্রতিরোধী অবকাঠামোর অভাব, যার জন্য ৫৭ শতাংশ পরিবার উল্লেখ করেছে। অপরদিকে, ৫৬ শতাংশ পরিবার অভিযোজনের জন্য সীমিত আর্থিক সম্পদের অভাবকে মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই পরিস্থিতির প্রভাব শুধু পরিবেশগত নয়, মানবিকও—বিশেষ করে দরিদ্র ও কৃষি-নির্ভর পরিবারগুলোর জন্য এ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটান বিভাগের ডিরেক্টর জঁ পেম বলেছেন, বাংলাদেশের জলবায়ু-সহনশীলতা বারবার নতুন করে পরীক্ষা নিচ্ছে। যদিও অভিযোজনের প্রচেষ্টা ব্যাপক, তবে ঝুঁকি দ্রুত বেড়ে চলেছে, তাই আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সহনশীলতা বাড়ানোর জন্য আগাম সতর্কবার্তা ব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষা, জলবায়ু-স্মার্ট কৃষি এবং ঝুঁকিমূলক অর্থায়নে জোর দেয়া জরুরি। শহরাঞ্চলেও লক্ষ্যভিত্তিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
প্রতিবেদনটি বলছে, সমন্বিত ও বহুপ্রতিবেশী অভিযোজন কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে জলবায়ুজনিত ক্ষতি কমানো সম্ভব। বিশেষ করে, আগাম সতর্কবার্তা, বিমার সুবিধা এবং ঋণ সহজলভ্যতা বাড়ালে এই ক্ষতিগুলোকে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস করা যেতে পারে। সরকার জনমুখী ও বেসরকারি খাতের মধ্যে আরও সহযোগিতা সৃষ্টি করলে অভিযোজনের গতি বৃদ্ধি পাবে, যেখানে বাজেটের সংকট থাকলেও পরিবহন, ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়ন এবং নমনীয় সামাজিক সুরক্ষার মাধ্যমে কার্যকর এগোতে পারা সম্ভব।
বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ও প্রতিবেদনের সহ-লেখক সিদ্ধার্থ শর্মা মন্তব্য করেছেন, ‘‘বাংলাদেশ অভিজ্ঞতার দিক থেকে জলবায়ু অভিযোজনের এক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার ক্ষেত্র।’’ তিনি আরও বলেন, দেশের মানুষ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই অভিযোজনের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে, কিন্তু জলবায়ুর পরিমাণ ও জটিলতা বিবেচনায় সরকার ও বেসরকারি খাতের এখনই সমন্বিত ও জরুরি পদক্ষেপ দরকার।






