বিশ্বব্যাংকের ইজ অব ডুয়িং বিজনেস বা সহজে ব্যবসা সূচকে ১০ বছর আগে বাংলাদেশের বেশ পেছনে ছিল ভারত। এরপর বাংলাদেশ শুধু পিছিয়েছে। আর ভারত মাত্র তিন বছরে ৫৩ ধাপ এগিয়ে ৭৭তম অবস্থানে উঠে এসেছে। তলানিতে থাকা আফগানিস্তান পাঁচটি কাজ করে ১৬ ধাপ লাফ দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংক ২০০৮ সালে যে ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৫তম। এরপর থেকে বাংলাদেশের অবস্থান শুধু নামছে। চলতি বছর এক ধাপ উন্নতি করে ১৯০টি দেশের মধ্যে অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১৭৬তম। তাতে দক্ষিণ এশিয়ার সব কটি দেশের পেছনে পড়েছে বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদন-২০১৯ গত ৩১ অক্টোবর প্রকাশ করা হয়। মোটা দাগে ১০টি ভিত্তির ওপরে বিশ্বব্যাংক ডুয়িং বিজনেসের র্যাঙ্কিং করে। এগুলো হলো ব্যবসা শুরুর অনুমোদন, ভবন নির্মাণের অনুমতি, বিদ্যুৎ–সংযোগ, সম্পত্তি নিবন্ধন, ঋণপ্রাপ্তি, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা, কর প্রদান, বৈদেশিক বাণিজ্য, চুক্তির বাস্তবায়ন ও দেউলিয়া ঘোষণার প্রক্রিয়া।
এ প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই আফগানিস্তানে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর শুভম চৌধুরী সংস্থাটির ওয়েবসাইটে এক লেখায় দেশটির উন্নতির কারণ তুলে ধরেন। তিনি জানান, আগে আফগানিস্তানে ব্যবসা শুরুর সনদ পেতে দেশটির মুদ্রায় ৩২ হাজার আফগানি (৪২০ মার্কিন ডলার) খরচ হতো। প্রক্রিয়া এক ছাদের নিচে নিয়ে এসে তারা ওই ব্যয় কমিয়ে ১০০ আফগানিতে নিয়ে এসেছে। দ্বিতীয় যে সংস্কার আফগানিস্তান করেছে, সেটি হলো বড় করদাতাদের কর দেওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করা। আফগানিস্তানের বড় করদাতারা এখন করের ঘোষণা অনলাইনে দিতে পারেন। পাশাপাশি তাঁদের কর স্বয়ংক্রিয়ভাবে হিসাব করা হয়। চলতি বছরের ৮ মার্চ আফগান সরকার নতুন সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি আইন পাস করে। এই নতুন আইন করপোরেট সুশাসন বাড়িয়েছে এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। আফগানিস্তান দেউলিয়া ঘোষণার ক্ষেত্রে নতুন আইন করেছে। নতুন আইনটি ব্যবসায়ীদের ঋণ পাওয়া সহজ করেছে বলেও উল্লেখ করে শুভম চৌধুরী।
এসব সংস্কার আফগানিস্তানকে বাংলাদেশের সামনে নিয়ে গেছে। তাদের অবস্থান ১৮৩ থেকে উন্নীত হয়ে ১৬৭তম হয়েছে। যদিও অর্থনীতি, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য—সব দিক দিয়ে বাংলাদেশের পেছনে তারা। দেশটিকে নিয়মিত সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করতে হয়। যুদ্ধের ধকলও কাটিয়ে উঠতে পারেনি এখনো তারা।
ভারতের উন্নতি কীভাবে, তা তুলে ধরেন বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর ঢাকা কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ এবং বাণিজ্য ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বিভাগের প্রধান মাশরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, ভারত ২০১৫ সালের শুরুর দিকে এ ক্ষেত্রে কার্যক্রম শুরু করে। এটি দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অগ্রাধিকার কাজের একটি।
ভারতের সংস্কারের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের পক্ষে কাজ করেছেন মাশরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, ভারতের উন্নতির মূল কারণ রাজনৈতিক নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায় থেকে লক্ষ্য ঠিক করা ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব ডুয়িং বিজনেসে সংস্কারের ক্ষেত্রে কতটুকু উন্নতি হলো, তা দুই মাস পরপর যাচাই করেন। আর প্রধানমন্ত্রী তিন মাসে একবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতি নিয়ে সভা করতেন, যার মধ্যে ডুয়িং বিজনেসও আলোচনায় আসে। তিনি আরও বলেন, ভারত ডুয়িং বিজনেসে উন্নতির জন্য কী কী করতে হবে, তার কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে তা ধরে ধরে বাস্তবায়ন করছে। কোনো কর্মকর্তা যদি তা করতে না পারেন, তাহলে তাঁকে জবাবদিহি করতে হয়।
অগ্রাধিকার দেওয়া এবং নিয়মিত নজরে রাখার সুফলও ভারত পেয়েছে। ২০১৬ সালের ডুয়িং বিজনেস সূচকে ভারতের অবস্থান ছিল ১৩০তম। দুই বছর পর তা ৭৬তম অবস্থানে উন্নীত হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার ডুয়িং বিজনেসে উন্নতির জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয় ২০১৬ সালে। ওই বছরের ১৯ নভেম্বর সোনারগাঁও হোটেলে সচিবদের নিয়ে এক সভায় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম এ সূচকে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে দুই অঙ্ক, অর্থাৎ কমপক্ষে ৯৯তম অবস্থানে নিয়ে আসার লক্ষ্যের কথা জানান। এরপর ডুয়িং বিজনেসের ১০টি বিষয়ের ৮টিতে কী কী সংস্কার করতে হবে, তা বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনাসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পাঠানো হয়। কিন্তু অভিযোগ আছে, ক্ষমতা ছাড়তে না চাওয়ার মানসিকতা সংস্কারকে আটকে রেখেছে। কিছুটা কাজ হয়েছে বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে। ফলে সেখানে উন্নতিও হয়েছে।
এ ছাড়া ব্যবসা শুরুর প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ৭ ধাপ পিছিয়ে ১৩৮, নির্মাণের অনুমতিতে ৮ ধাপ পিছিয়ে ১৩৮, ঋণের প্রাপ্যতায় ২ ধাপ পিছিয়ে ১৬১, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় ১৩ ধাপ পিছিয়ে ৮৯, বৈদেশিক বাণিজ্যে ৩ ধাপ পিছিয়ে ১৭৬, দেউলিয়া ঘোষণার প্রক্রিয়ায় ১ ধাপ পিছিয়ে ১৫৩তম অবস্থান পেয়েছে।
বাংলাদেশেও ডুয়িং বিজনেসে উন্নতির সঙ্গে কাজ করছেন মাশরুর রিয়াজ। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য কী, জানতে চাইলে তিনি দুই দেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, বাংলাদেশে বিডা আপ্রাণ চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা আছে। এখন প্রতিটা বিষয় অনুযায়ী বাস্তবায়নের জন্য টাস্কফোর্স দরকার এবং কাজ কতটুকু হচ্ছে, তার সমন্বিত নজরদারি দরকার।