* বিও হিসাব ছাড়া বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে লেনদেন করতে পারেন না
* জুন শেষে বাজারে মোট বিও হিসাব ছিল প্রায় ২৭ লাখ ৬৬ হাজার
* এর মধ্যে প্রায় ৫৩ শতাংশ বিও হিসাবে কোনো শেয়ার নেই
শেয়ারবাজারের ৩০ লাখ বিনিয়োগকারী বলে যাঁরা দাবি করেন, সেই তথ্যটি সঠিক নয়। কারণ পরিসংখ্যান বলছে, গত জুন শেষে শেয়ারবাজারের প্রকৃত বিনিয়োগকারী ১৩ লাখের মতো। কারণ, এসব বিনিয়োগকারীর বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স বা সুবিধাভোগী) হিসাবে শেয়ার আছে। শেয়ারবাজারের বিও হিসাব–সংক্রান্ত গত কয়েক বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাজারের প্রায় অর্ধেক বিও হিসাবই গত চার বছর নিষ্ক্রিয় থাকছে।
শেয়ারবাজারে শেয়ার লেনদেনের ক্ষেত্রে বিও হিসাব আবশ্যকীয় উপাদান। বিও হিসাব ছাড়া কোনো বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে লেনদেন করতে পারেন না। প্রতিটি বিও হিসাবের জন্য প্রত্যেক বিনিয়োগকারীকে বছরে ৪৫০ টাকা রক্ষণাবেক্ষণ মাশুল দিতে হয়। নিয়ম অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি বিনিয়োগকারী একটি ব্রোকারেজ হাউসে নিজ নামে ও যৌথ নামে সর্বোচ্চ দুটি হিসাব খুলতে পারেন। একটি বিও হিসাব মানে একজন বিনিয়োগকারী হিসাব করা হয়।
বিও হিসাবের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাজারে যত বিও হিসাব আছে, তার অর্ধেকের বেশি বিও হিসাবে হয় শেয়ার থাকছে না, নয়তো ব্যবহার হচ্ছে না। ফলে যত বিও হিসাব থাকছে, তার অর্ধেকেরও কম বাজারে সক্রিয় আছে। বিও হিসাব সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) একাধিক বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
সিডিবিএলের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মূলত ২০১৩ সালের পর থেকে বাজারে নিষ্ক্রিয় বিও হিসাবের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। সর্বশেষ চলতি বছরের জুনে সমাপ্ত আর্থিক বছরের হিসাবে বাজারে মোট বিও হিসাবের ৫৩ শতাংশ বা অর্ধেকেরও বেশি নিষ্ক্রিয়। চলতি বছরের জুন শেষে শেয়ারবাজারে মোট বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ ৬৬ হাজার ৩৮৩টি। এর মধ্যে ১০ লাখ ৩৮ হাজার ৪২৯টি বিও হিসাব ছিল শেয়ারশূন্য। আর ৪ লাখ ২৪ হাজার ২২৪টি বিও হিসাব ছিল অব্যবহৃত। শেয়ারশূন্য ও অব্যবহৃত এই দুই মিলিয়ে নিষ্ক্রিয় হিসাব মোট ১৪ লাখ ৬২ হাজার ৬৫৩টি। আর সক্রিয় বিও হিসাবের সংখ্যা ১৩ লাখ ৩ হাজার ৭৩০টি।
শেয়ারবাজারে যেসব বিও হিসাবে শেয়ার জমা রয়েছে এবং যেগুলো শেয়ার কেনাবেচায় ব্যবহৃত হয়, সেসব হিসাবই কেবল সক্রিয় বিও হিসাব হিসেবে ধরা যায়। যেসব হিসাব কখনো ব্যবহার হয়নি ও শেয়ারশূন্য সেসব বিও হিসাবের অবস্থা ‘কাজির গরুর’ প্রবাদের মতো। কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই। অথচ বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সব সময় দাবি করেন শেয়ারবাজারে ২৫ থেকে ৩০ লাখ বিনিয়োগকারী যুক্ত রয়েছেন। তবে সিডিবিএলের বিও হিসাব–সংক্রান্ত তথ্য বলছে, ২৫ থেকে ৩০ লাখ বিনিয়োগকারীর মধ্যে একটি বড় অংশেরই বাজারে নিয়মিত কোনো অংশগ্রহণ নেই। গত পাঁচ বছরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শেয়ারবাজারের লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এমন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ১৩ থেকে প্রায় ১৭ লাখের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। গত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে শেয়ারধারণ করা বিও হিসাবের সংখ্যা দিন দিন কমেছে। তার বিপরীতে বেড়েছে শেয়ারশূন্য বিও হিসাব।
জানতে চাইলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ‘সব সময়ই আমাদের বাজারে কিছু বিও হিসাব ছিল, যেগুলো কখনোই নিয়মিত শেয়ার লেনদেনে ব্যবহৃত হতো না। শুধু প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও আবেদনের জন্য এসব বিও হিসাব ব্যবহৃত হয়। এ কারণে এসব বিও হিসাবকে নিষ্ক্রিয় ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু নিষ্ক্রিয় বিও হিসাবের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া বাজারের জন্য মোটেই সুখকর নয়।’
এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান বলেন, সেকেন্ডারি বাজারে ১২ থেকে ১৫ লাখের বেশি বিনিয়োগকারী নেই। তবুও যত বিও হিসাব তত বিনিয়োগকারী হিসাব করা হয়। কারণ, যেকোনো সময় যেকোনো বিনিয়োগকারী বিও হিসাবের মাধ্যমে লেনদেনে অংশ নিতে পারেন। বিনিয়োগকারীদের বড় অংশই আইপিও আবেদনের জন্যই শুধু বিও ব্যবহার করে।
সিডিবিএলের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে শেয়ারধারণ করা বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৪৬টি। ২০১৫ সালে তা কমে নেমে আসে ১৫ লাখ ৯১ হাজার ৫১৮টিতে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ১ লাখ বিও হিসাব থেকে শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ায় এসব হিসাব শেয়ারশূন্য হয়ে অকার্যকর বিও হিসাবে পরিণত হয়। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে এসে শেয়ার আছে এমন বিও হিসাবের সংখ্যা আরও কমে দাঁড়ায় ১৫ লাখ ৩১ হাজার ৪৯২টিতে। ২০১৭ সালে তা আগের বছরের চেয়ে প্রায় সোয়া ২ লাখ কমে নেমে আসে ১২ লাখ ৯৯ হাজার ৪৪৭টিতে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের জুন শেষে তা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৪ হাজার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৩ হাজার ৭৩০টিতে।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আরও বলেন, সেকেন্ডারি বাজারে লেনদেন করে এ রকম বিও হিসাব ১২ থেকে ১৫ লাখ। বাজার এগিয়ে নিতে হলে সেকেন্ডারি বাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। ভালো কোম্পানি বাজারে না এলে সেটি হবে না।
মসলিন ক্যাপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়ালি উল মারুফ মতিন বলেন, ‘আগে থেকেই আমাদের ধারণা ছিল যত বিও হিসাব রয়েছে, সেগুলো বাজারে কার্যকর নয়। তবে আমাদের বাজারের জন্য বেশিসংখ্যক বিনিয়োগকারীর চেয়ে বেশি দরকার বাজার সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখে, এমন বিনিয়োগকারী।